গ্যানিমিড আর এলিয়েনার বনে আগমন ও কুটির ক্রয়ের (যে কথার উল্লেখ আগেই করা হয়েছে) অল্প দিনের মধ্যেই বনে এসেছিল অর্ল্যান্ডো।
একদিন গ্যানিমিড ও এলিয়েনা অবাক হয়ে দেখল, বনের গাছে খোদিত রোজালিন্ডের নাম। সঙ্গে লটকানো রয়েছে রোজালিন্ডকে নিয়ে লেখা কয়েকটি প্রেমের চতুর্দশপদী। দুই বোনে ভাবছে এগুলি কার লেখা, এমন সময় তারা দেখা পেল অর্ল্যান্ডোর। রোজালিন্ড অর্ল্যান্ডোকে যে হারটি দিয়েছিল, সেটি দেখেই তারা ওকে চিনল।
গ্যানিমিডই যে দয়া ও মহত্বে অর্ল্যান্ডোর হৃদয়-বিজয়িনী সুন্দরী রাজকন্যা রোজালিন্ড, সেকথা টেরই পেল না অর্ল্যান্ডো। সে রোজালিন্ডের রূপের প্রশস্তি করে গাছে গাছে সনেট ঝুলিয়ে বেড়াচ্ছিল। রাখাল যুবকের সঙ্গে গল্প করতে করতে করতে তার মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলি ভারি ভাল লাগে গেল অর্ল্যান্ডোর। গ্যানিমিডের চেহারায় রোজালিন্ডের একটা আভাস ছিল বটে। কিন্তু তার আচরণ রোজালিন্ডের মতো নম্র ছিল না। আসলে গ্যানিমিড বালক-পুরুষদের কথোপকথনের ভঙ্গি নকল করে কথা বলছিল। সে ঠাট্টা করে অর্ল্যান্ডোকে জনৈক প্রেমিকের গল্প শুনিয়ে বলল, “ছেলেটা আমাদের বনে শিকার করে আর রোজালিন্ডের নাম লিখে লিখে ছোটো গাছগুলিকে নষ্ট করে। রোজালিন্ডের প্রশস্তি গেয়ে হথর্নের উপর দীর্ঘ গীতিকবিতা আর ব্র্যাম্বলের উপর শোকগাথা লেখে। এই প্রেমিকটাকে খুঁজে পেলে আমি তার এই প্রেমরোগ সারানোর ওষুধের নাম বাতলে দেবো।”
অর্ল্যান্ডো স্বীকার করে নিল যে, সে-ই হল উক্ত প্রেমিক। গ্যানিমিডের কাছে সে ওষুধের পরামর্শ চাইল। গ্যানিমিড তাকে রোজ তার আর এলিয়েনার কুটিরে আসতে বলল। বলল, “আমি রোজালিন্ড সাজব। তুমি আমাকে প্রেম নিবেদনের ভান করবে, ঠিক যেমন আমি রোজালিন্ড হলে তুমি করতে। আমি তোমার সামনে খেয়ালি মেয়েদের হাবভাব নকল করে দেখাবো। তখন প্রেমে পড়ার জন্য তোমারই লজ্জা হবে আর তোমার রোগও যাবে সেরে।” এহেন চিকিৎসার প্রতি যদিও অর্ল্যান্ডোর খুব একটা আস্থা জন্মালো না, তবু সে গ্যানিমিডের কুটিরে যেতে ও সেই মজার প্রেম নিবেদনের খেলা খেলতে রাজি হল। তারপর থেকে প্রতিদিন অর্ল্যান্ডো গ্যানিমিড ও এলিয়েনার সঙ্গে দেখা করতে গেল। অর্ল্যান্ডো রাখাল গ্যানিমিডকে রোজালিন্ড সম্বোধন করতে লাগল। যেমন করে প্রতিদিন যুবকেরা নতুন নতুন স্তববাক্যে প্রেমিকার হৃদয় জয়ের চেষ্টা করে, তেমনি করে গ্যানিমিডের কাছে প্রেম নিবেদন করল অর্ল্যান্ডো। তবে তার প্রেমরোগ নিরাময়ে গ্যানিমিড খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারল না।
অর্ল্যান্ডোর কাছে এ ছিল খেলা। সে তো আর ভাবেনি যে গ্যানিমিডই আসলে রোজালিন্ড। তবুও মনের সব কথা সে প্রাণ খুলে উজার করে দিল গ্যানিমিডের কাছে। খুশি হল গ্যানিমিড। সে অন্তত জানত যে, কথাগুলি ঠিক লোকের কাছেই যাচ্ছিল।
গ্যানিমিডকে সুখী দেখে এলিয়েনাও তাকে তার মতো থাকতে দিল। বাধা দিল না তার নকল প্রেম নিবেদনের খেলায়। একবারের জন্যও তাকে মনে করিয়ে দিল না যে, রোজালিন্ডের বেশে এখনও তার বাবার কাছে দেখা দেয়নি সে। যদিও অর্ল্যান্ডোর কাছ থেকে তারা জানতে পেরেছিল যে, ডিউক এই বনেই আছেন। একদিন গ্যানিমিডের সঙ্গে ডিউকের দেখা হল। তাঁদের কিছু কথাও হল। ডিউক গ্যানিমিডের পিতৃপরিচয় জানতে চাইলে সে বলল, সে ডিউকের মতোই ভদ্রঘরের ছেলে। ডিউক হাসলেন। আসলে তিনি ভাবতেও পারেননি যেই তরুণ রাখাল রাজপরিবারের সন্তান হতে পারে। ডিউককে সুখী দেখে গ্যানিমিড ঠিক করল, আরও কিছুদিন সে পরিচয় গোপন রাখবে।
একদিন সকালে গ্যানিমিডের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে অর্ল্যান্ডো, এমন সময় দেখল, একটা লোক মাটিয়ে শুয়ে রয়েছে আর তার গলার কাছে গুটিয়ে রয়েছে একটা বিরাট সবুজ সাপ। সাপটা অর্ল্যান্ডোকে দেখেই ঝোপের মধ্যে পালিয়ে গেল। অর্ল্যান্ডো একটু কাছে আসতেই একটা সিংহীকে দেখতে পেল। সিংহীটা মাটিতে মাথা রেখে গুটি গুটি পায়ে বিড়ালের মতো এগিয়ে আসছিল। ঘুমন্ত লোকটি জেগে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিল সে (কারণ, বলা হয়, সিংহ মৃত বা ঘুমন্তকে শিকার করে না)। ঈশ্বরই যেন অর্ল্যান্ডোকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন লোকটিকে সাপ ও সিংহীর হাত থেকে উদ্ধার করতে। কিন্তু লোকটার মুখের দিকে তাকাতেই সে বুঝতে পারল, যাকে সে জোড়া বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করতে চলেছে সে আসলে তার নিজের দাদা অলিভার, যে একদিন তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল, এমনকি তার ঘরে আগুন দিয়ে তাকে হত্যাও করতে চেয়েছিল। প্রথমে সে ভাবল, দাদাকে ক্ষুধার্ত সিংহীর মুখেই ছেড়ে যাবে। কিন্তু তারপরেই ভ্রাতৃপ্রেম ও স্বভাবগত দয়া তার প্রাথমিক রাগ দূর করে দিল। সে তরবারি বের করে সিংহীটাকে আক্রমণ করে তাকে হত্যা করল। দাদাকে রক্ষা করলবিষধর সাপ ও হিংস্র সিংহীর হাত থেকে । তবে সিংহীটাকে হত্যা করার আগে, সে তার তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে অর্ল্যান্ডোর হাতে দিল আঁচড়ে।
অর্ল্যান্ডো যখন সিংহীর সঙ্গে যুদ্ধ করছিল, তখন অলিভারের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি দেখলেন, যে ভাইয়ের প্রতি তিনি এত নিষ্ঠুরতা করেছিলেন, সে-ই কিনা নিজের জীবন বিপন্ন করে তাকে বন্য জন্তুর হাত থেকে রক্ষা করল। লজ্জা ও ধিক্কার গ্রাস করল তাঁকে। নিজের পূর্বকৃত ব্যবহারের জন্য অনুতাপ করতে লাগলেন তিনি। সজল চোখে ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইলেন। তাকে অনুতপ্ত হতে দেখে অর্ল্যান্ডোর খুব ভাল লাগল। সে এককথায় দাদাকে ক্ষমা করে দিল। দুই ভাই একে অপরকে আলিঙ্গন করল। অর্ল্যান্ডোকে হত্যা করতে এসে তার সঙ্গে সত্যিকারের ভ্রাতৃপ্রেমে আবদ্ধ হলেন অলিভার।