অন্তঃপুরে নিভৃত আলাপের সময় রোজালিন্ড ঘুরে ফিরে শুধু অর্ল্যান্ডোর কথাই বলতে লাগল। সেলিয়া বুঝতে পারল, তার বোন সুদর্শন তরুণ মল্লযোদ্ধাটির প্রেমে পড়েছে। সে রোজালিন্ডকে বলল, “এও কী সম্ভব? এত সহজে তুই ওর প্রেমে পড়ে গেলি?” রোজালিন্ড বলল, “ডিউক, মানে আমার বাবা, ওঁর বাবাকে খুব ভালবাসতেন কিনা!” সেলিয়া বলল, “তোর বাবা ওর বাবাকে ভালবাসতেন বলেই তুই ওর প্রেমে পড়ে গেলি। আমার বাবা তো ওর বাবাকে অপছন্দ করতেন। কই, আমার তো ওকে খারাপ লাগেনি!”
এদিকে রোল্যান্ড ডে বয়েজের ছেলেকে দেখে ফ্রেডেরিক উঠলেন খেপে। তাঁর মনে পড়ে গেল, অভিজাত রাজপুরুষদের মধ্যে অনেকেই নির্বাসিত ডিউকের বন্ধু ছিলেন। ভাইঝির প্রতিও হঠাৎ তাঁর রাগ হতে লাগল। কারণ, সবাই ওর গুণের প্রশংসা করত আর ওর বাবার দুর্ভাগ্যের জন্য ওর প্রতি সহানুভূতি দেখাত। সেলিয়া আর রোজালিন্ড অর্ল্যান্ডোকে নিয়ে কথা বলছে, এমন সময় ফ্রেডেরিক সেই ঘরে এসে হাজির হলেন। দৃষ্টিতে আগুন ছিটিয়ে ফ্রেডেরিক রোজালিন্ডকে প্রাসাদ ছেড়ে নির্বাসিত বাবার কাছে চলে যেতেআদেশ করলেন। সেলিয়া বাবাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু তার কথায় কান না দিয়ে ফ্রেডেরিক বললেন, রোজালিন্ডের মতো মেয়ের সঙ্গে তার থাকা উচিত নয়। সেলিয়া বলল, “তেমন হলে ওকে রেখে দেওয়ার কথা আদৌ তুলতাম না। আগে ছোটো ছিলাম। তাই ও কেমন মেয়ে বুঝতাম না। কিন্তু আজ এত দিন ধরে একসঙ্গে খেয়ে, ঘুমিয়ে, খেলে, লেখাপড়া করে আমি ও আসলে কেমন মেয়ে তা বুঝতে পারি। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না।” ফ্রেডেরিক বললেন, “তুই বোকার মতো ওর সালিশি করছিস। ওর রূপ, ওর ওই চুপ করে থাকা, ওর ধৈর্য দেখে লোকেরা ওর প্রতি সহানুভূতি দেখায়। ও চলে গেলে তোকে রূপে গুণে আরও মহীয়সী মনে হবে। তাই ওর হয়ে কথা বলিস না। জেনে রাখিস, আমার আদেশের নড়চড় হবে না।”
রোজালিন্ডকে কাছে রেখে দেওয়ার জন্য বাবার কাছে সেলিয়ার সব আবেদনই নিষ্ফল হয়ে গেল। তখন সে নিজে রোজালিন্ডের পাশে দাঁড়াল। সেই রাতেই বাবার প্রাসাদ থেকে পালিয়ে এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আর্ডেনের বনে রোজালিন্ডের বাবাকে খুঁজতে যাওয়ার প্রস্তাব দিল।
যাত্রা শুরুর আগে সেলিয়ার মনে হল, দামি পোষাক পরে দুই অল্পবয়সী মেয়ের রাস্তায় চলা নিরাপদ হবে না। সে গ্রামের মেয়েদের পোষাক পরে বের হওয়ার কথা বলল। রোজালিন্ড বলল, সবচেয়ে ভাল হবে, যদি তাদের একজন পুরুষ সাজে। তাই ঠিক হল। রোজালিন্ড দীর্ঘকায়া। সে গ্রাম্য যুবকের ছদ্মবেশ নিল। সেলিয়া পরল গ্রাম্য মেয়ের পোষাক। দুইজনে সাজল ভাই-বোন। রোজালিন্ড হল গ্যানিমিড আর সেলিয়া হল এলিয়েনা।
অনেক দূরের পথ আর্ডেনের বন। ডিউক-রাজ্যের সীমানার বাইরে। তাই এই দীর্ঘপথের রাহাখরচ হিসেবে কিছু টাকাপয়সা ও ধনরত্নও সঙ্গে নিল তারা। তারপর রওনা হল বনের উদ্দেশ্যে।
পুরুষবেশে লেডি রোজালিন্ড (বা যাঁকে এখন গ্যানিমিড বলাই ভাল) পুরুষালি দৃপ্ত ভঙ্গিমায় চলতে লাগল। সেলিয়া তার সত্যিকারের বন্ধু। বিশ্বস্ত বন্ধুত্বের প্রতিদানস্বরূপ সিলিয়া তার নতুন ভাইয়ের সঙ্গে এই কষ্টদায়ক যাত্রায় অংশ নিল। তার আচরণে লোকে মনে করল, এই ছেলেটি সত্যিই এলিয়েনা নামে এক সুকুমারী গ্রাম্য বালিকার দাদা কঠোর-হৃদয় গ্রাম্যযুবক গ্যানিমিড।
পথে তারা কয়েকটা আরামদায়ক সরাই আর ভাল থাকার জায়গা পেয়েছিল। কিন্তু আর্ডেনের বনে পৌঁছে তারা সেরকম কিছুই পেল না। গ্যানিমিড এতক্ষণ মজার মজার কথা বলে বোনের চিত্তবিনোদন করতে করতে আসছিল। এইবার খাবার আর আশ্রয়ের জন্য সেও কাতর হয়ে পড়ল। এলিয়েনার কাছে স্বীকার করল, পুরুষবেশ ফেলে মেয়েদের মতো চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। এলিয়েনা বলল, ক্লান্তিতে তা পা অবশ হয়ে আসছে। মেয়েরা দুর্বল, তাই তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা আর সান্ত্বনা দেওয়া পুরুষদেরই কাজ – এই কথা ভেবে পুরুষালি ভাব দেখিয়ে গ্যানিমিড বলল, “আয়, এলিয়েনা, বোন আমার। আর একটুখানি। এই তো আমরা আর্ডেনের বনের কাছে এসেই পড়েছি।” কিন্তু কল্পিত পুরুষত্ব আর আরোপিত সাহস আর তার সঙ্গ দিল না। আর্ডেনের বনে তারা এসে পোঁছেছিল বটে। কিন্তু ডিউক এই বনের কোথায় আছেন তা তো আর তাদের জানা ছিল না। তারা ভাবল যে তারা বোধহয় পথ হারিয়েছে। খিদেয়, ক্লান্তিতে, অবসাদে হতোদ্যম ও মৃতপ্রায় হয়ে ঘাসের উপর বসে পড়ল। এমন সময় একটি গ্রাম্য লোক সেই খান দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে দেখে গ্যানিমিড আর একবার পুরুষের ভাব করে গম্ভীরভাবে বলল, “রাখাল, এই নির্জন স্থানে আমাদের বিশ্রামস্থলের বড়ো প্রয়োজন। আমার এই ছোটো বোনটি যাত্রার ক্লান্তিতে আর ক্ষুধায় অবশ হয়ে আর চলতে পারছে না। আমাদের এমন কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারো, যেখানে আমরা দু’টি খেয়ে বিশ্রাম করতে পারব। তার বদলে যা চাও দেবো।”
লোকটি বলল যে, সে রাখাল নয়, এক রাখালের পরিচারক মাত্র। তার প্রভুর বসতবাড়িখানা খুব শীঘ্রই বিক্রি করে দেওয়া হবে। তাই সেখানে থাকা-খাওয়ার খুব একটা সুরাহা হওয়া সম্ভব নয়। তবে চাইলে তারাই বাড়িটা কিনে নিতে পারে। থাকা-খাওয়ার একটা সুরাহার আশায় তাদের দেহে নতুন বলসঞ্চার হল। তারা লোকটির সঙ্গে চলে গেল। কিনে নিল সেই রাখালের বাড়ি ও তার ভেড়ার পাল। যে লোকটি তাদের রাখালের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল, তাকে তারা পরিচারক নিযুক্ত করল। এইভাবে ভাগ্যক্রমে তারা একটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কুটির পেয়ে গেল। খাওয়ার চিন্তাও আর রইল না। তারা ঠিক করল, যতক্ষণ না বনের মধ্যে কোথায় ডিউক আছেন তা জানতে পারে, ততক্ষণ তারা সেখানেই থাকবে।