নির্বাসিত ডিউকের রোজালিন্ড নামে একটি মেয়ে ছিল। প্রবঞ্চক ডিউক ফ্রেডেরিক তার বাবাকে বিতাড়িত করলেও, রোজালিন্ডকে নিজের মেয়ে সেলিয়ার সঙ্গিনী হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন। দুই বোন একে অপরকে খুব ভালবাসত। তাদের জন্মদাতাদের পারস্পরিক বিবাদ তাদের ভালবাসার বাঁধন আলগা করে দিতে পারেনি। রোজালিন্ডের বাবাকে রাজ্যচ্যূত করে তাঁর প্রতি যে অবিচার করা হয়েছিল, সেই ক্ষত রোজালিন্ডের মন থেকে মুছে দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করত সেলিয়া। বাবার নির্বাসন এবং এক মিথ্যা প্রবঞ্চকের দাক্ষিণ্যে জীবনধারণের গ্লানি রোজালিন্ডকে গ্রাস করলেই সেলিয়ে এগিয়ে আসত তাকে সান্ত্বনা দিতে।
একদিন ডিউকের এক দূত এসে জানালো, মল্লযুদ্ধ দেখার ইচ্ছে থাকলে মেয়েরা যেন তক্ষুনি রাজপ্রাসাদ-লাগোয়া রাজসভায় চলে আসে; কারণ, একটি মল্লযুদ্ধের আসর বসতে চলেছে সেখানে। সেলিয়া ভাবল, সেখানে গেলে অন্তত রোজালিন্ড একটু আমোদ পাবে। তাই সে রাজি হয়ে গেল।
আজকাল মল্লযুদ্ধ মানে গেঁয়ো চাষাভুষোদের খেলা। কিন্তু সেকালে এই খেলা ছিল রাজসভার একটি প্রিয় অবসর বিনোদন। রাজকুমারী সহ অন্যান্য অভিজাত রমণীরা এই খেলা দেখতে আসতেন। সেলিয়া ও রোজালিন্ড গেলেন সেই মল্লযুদ্ধের আসরে। কিন্তু গিয়ে যা দেখলেন, তাতে তাদের বুক ফেটে গেল। আসরের একদিকে এক অভিজ্ঞ মল্লযোদ্ধা, যিনি কিনা তাঁর মতো বহু দক্ষ যোদ্ধাকে প্রতিযোগিতার আসরে নিকেশ করেছেন; আর অন্য দিকে তাঁর বিরুদ্ধে নামা একটি অত্যন্ত অল্পবয়সী যুবক। ছেলেটির বয়স ও অভিজ্ঞতা, দুইই এত অল্প ছিল যে সবাই ধরেই নিয়েছিল, এই আসরেই তার ভবলীলা সাঙ্গ হতে চলেছে।
মেয়ে সেলিয়া ও ভাইঝি রোজালিন্ডকে দেখে ডিউক বললেন, “এই যে, আমার মায়েরাও গুটিগুটি পায়ে মল্লযুদ্ধ দেখতে এসেছো দেখছি। তবে আজকের খেলা তোমাদের ততটা ভাল লাগবে না। ঠিক সমকক্ষ যোদ্ধাদের মধ্যে তো আর যুদ্ধ হচ্ছে না। ছেলেটাকে দেখে দয়া হচ্ছে আমার। ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আসর থেকে সরিয়ে আনতে পারলেই মঙ্গল হয়। তা মায়েরা, তোমরা একবার ওর সঙ্গে কথা বলে দ্যাখো না, যদি ওকে বোঝাতে পারো।”
কাজটি সৎ। তাই ওদের বেশ মনে ধরল। প্রথমে সেলিয়া এসে তরুণ আগন্তুকটির সঙ্গে কথা বলল। অনুরোধ করল প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়াতে। তারপর রোজালিন্ড এসে মিষ্টি কথায় তাকে বুঝিয়ে বলল এই প্রতিযোগিতা কেন তার পক্ষে বিপজ্জনক। কিন্তু সেই মিষ্টি কথার ফল হল উল্টো। যুবক তার সংকল্প তো ত্যাগ করলই না, বরং সুন্দরীদের সামনে নিজের শৌর্যপ্রদর্শনের একটা অদম্য ইচ্ছে চেপে বসল তার মনে। সে সবিনয়ে সেলিয়া ও রোজালিন্ডের অনুরোধ ফিরিয়ে দিল। মেয়েরা তো মহাশঙ্কিত হয়ে উঠল। শেষে যুবক বলল, “আপনাদের মতো সুন্দরীদের অনুরোধ ফিরিয়ে দিতে আমার খুবই খারাপ লাগছে। আপনাদের শুভেচ্ছা দৃষ্টি এই প্রতিযোগিতায় আমার সহায়ক হোক। পরাজিত হলে জানবেন, আমি মহৎ কেউ ছিলাম না। আমার মৃত্যু হলে জানবেন, এক মৃত্যুপিপাসীর মৃত্যু হয়েছে। তাতে কারো কোনো ক্ষতি হবে না। আমার জন্য কাঁদার কেউ নেই। আমার জন্য জগতের কিছুই আটকাবে না। জগতে আমার কিছুই নেই। বরং যে জায়গাটুকু আমি দখল করে আছি, সেটুকু খালি হয়ে গেলে, সেখানে যোগ্যতর কেউ আসতে পারবে।”
এক নির্বান্ধব পরিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ছেলেটি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চাইছিল দেখে ছেলেটির প্রতি সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিল রোজালিন্ডের। সে দেখল, ছেলেটি তো তারই মতো হতভাগ্য। রোজালিন্ডের দয়া হচ্ছিল ছেলেটির প্রতি। খেলার কঠিন মুহুর্তগুলির প্রতি তার একনিষ্ট মনযোগই বলে দিচ্ছিল, সে সেই মুহুর্তেই ছেলেটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিল।
দুই সুন্দরী অভিজাত রমণীর দয়া দেখে আগন্তুক যুবকের সাহস ও শক্তি দুইই বেড়ে গিয়েছিল। সে বিস্ময় সাধন করে প্রতিযোগীকে সম্পূর্ণ পরাভূত করল। লোকটার নড়াচড়া করার তো দূরের কথা, কথা বলারও ক্ষমতা রইল না।
ডিউক ফ্রেডেরিক তরুণ আগন্তুকের সাহস ও দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হলেন। ছেলেটিকে নিজের তত্ত্বাবধানে রাখার মানসে তার নাম ও পিতৃপরিচয় জানতে চাইলেন।
আগন্তুক জানালো যে, সে স্যার রোল্যান্ড ডে বয়েজের ছোটো ছেলে অর্ল্যান্ডো।
অর্ল্যান্ডোর বাবা স্যার রোল্যান্ড ডে বয়েজ বছর কয়েক আগেই মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু বেঁচে থাকতে তিনি ছিলেন নির্বাসিত ডিউকের এক অনুগত প্রজা ও বিশ্বস্ত বন্ধু। অর্ল্যান্ডো তার নির্বাসিত দাদার বন্ধুপুত্র জানা ফ্রেডেরিকের মন গেল বিষিয়ে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। দাদার বন্ধুদের নামও শুনতে চাইতেন না তিনি। ছেলেটির বীরত্ব তাঁকে মুগ্ধ করেছিল বলে তিনি শুধু এইটুকু বলে গেলেন, অর্ল্যান্ডো অন্য কারোর ছেলে হলে তাঁর ভাল লাগত।
রোজালিন্ড কিন্তু তার বাবার পুরনো বন্ধুর ছেলেকে দেখে খুব খুশি হল। সে সেলিয়াকে বলল, “আমার বাবা স্যার রোল্যান্ড ডে বয়েজকে খুব ভালবাসতেন। যদি আগে জানতাম যে, এই যুবক তাঁর ছেলে, তাহলে চোখের জলে তাঁকে স্বাগত জানাতুম।”
দুই বোন তখন গেল যুবকের কাছে। ডিউকের হঠাৎ-অসন্তোষে ছেলেটি কিঞ্চিৎ হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। দু’বোনে মিলে নরম কথায় তাকে উৎসাহিত করল। চলে আসার সময় আর একবার ফিরে এসে রোজালিন্ড তার বাবার মৃত বন্ধুর ছেলের সঙ্গে দু’টো ভদ্রতার কথা বলল। নিজের গলার হার খুলে সে বলল, “মহাশয়, আমার এই উপহার গ্রহণ করুন। আমার এই হতভাগ্য দশা না হলে, আপনাকে আরও মূল্যবান কিছু উপহার দিতাম।”