বাড়ি ফিরে এসে হেলেনা সেই ভদ্রমহিলাকে বললেন, দেখুন, আমার নাম হেলেনা। কিছুদিন আগে আমারই সাথে বিয়ে হয়েছে কাউন্ট বারট্রামের। আমার কাছ থেকে দূরে সরে থাকতেই উনি ফ্রান্স ছেড়ে ফ্লোরেন্সে এসেছেন। এবার আপনি আর আপনার মেয়ে — দুজনে সাহায্য করলে আমি ফিরে পেতে পারি। আমার স্বামীকে।
কী সাহায্য তুমি চাও? জানতে চাইলেন ভদ্রমহিলা।
হেলেনা বলল, আপনি এখনই কাউন্ট বারট্রামকে খবর পাঠান যে আপনার মেয়ে তার সাথে দেখা করতে রাজি আছে।
এর ফল কী হবে তা ভেবে দেখেছ? জানতে চাইলেন ভদ্রমহিলা।
হ্যাঃ আমি ভেবে দেখেছি, বলল হেলেনা, খবর পেলে কাউন্ট অবশ্যই এসে যাবেন আজি রাতে। তবে আপনার মেয়ের পোশাক পরে আমি দেখা করব তার সাথে আমার উদ্দেশ্য কাউন্টের আঙুলে যে আংটিটি রয়েছে তা খুলে নেওয়া। তিনি বলেছেন। আংটি খুলে নিতে পারলেই উনি আমায় স্ত্রীর সম্মান দেবেন। আপনি অনুগ্রহ করে কাউন্টকে জানিয়ে দিন যে তার স্ত্রী হেলেনা অর্থাৎ আমি আর বেঁচে নেই।
হেলেনার দুঃখের কাহিনি শুনে ভদ্রমহিলা তাকে সহানুভূতি জানিয়ে আশ্বাস দিলেন তার পরিকল্পনা রূপায়ণে তিনি অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন।
সেদিন গভীর রাতে সাজগোজ করে কাউন্ট এসে হাজির হলেন সেই মহিলার বাড়িতে। তিনি সোজা ঢুকে গেলেন তার মেয়ে ডায়নার ঘরে। সেখানে তখন ডায়ানার পোশাক পরে অপেক্ষা করছিল হেলেনা। তিনি তাকে চিনতে পারলেন না। ডায়ানা ভেবে তিনি তাকে প্রেম নিবেদন করতে লাগলেন। শেষমেশ তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। সুযোগ পেয়ে প্রেমের নিদর্শন হিসেবে বারট্রামের একটি আংটি চাইল হেলেনা। শুরুতে রাজি না হলেও শেষমেশ আঙুল থেকে আংটিটা খুলে নিজেই পরিয়ে দিলেন হেলেনার আঙুলে। সারারাত ডায়না-বেশী হেলেনার সাথে কাটালেন বারট্রাম। সকাল হবার আগেই তিনি বিদায় নিয়ে যাত্রা করলেন রুসিলনের পথে। সেই একই দিনে ভদ্রমহিলা ও তার মেয়ে ডায়ানাকে সাথে নিয়ে হেলেনাও রওনা দিলেন রুসিলন অভিমুখে।
এদিকে বৃদ্ধ কাউন্টেসের অসুস্থতার কথা শুনে ফরাসি সম্রাট স্বয়ং এসেছেন তাকে দেখতে। হেলেনার মৃত্যুসংবাদ শুনে মনে খুব আঘাত পেলেন কাউন্টেস। হেলেনাকে পরিত্যাগ করার জন্য সম্রাট খুবই বাকা-ঝকা করলেন বারট্রামকে। এরই মধ্যে ডায়ানাকে বিয়ে করার সমস্ত ব্যবস্থা ঠিক করে রেখেছেন বারট্রাম। কিন্তু তার আগেই হেলেনা এসে হাজির সেখানে। তার হাতে নিজের আংটি দেখে চমকে উঠলেন বারট্রাম। তিনি হেলেনার কাছে জানতে চাইলেন আংটিটা সে কোথায় পেয়েছে। হেলেনা বলল ফ্লোরেন্সে সেই ভদ্রমহিলার বাড়িতে তিনি সারারাত তার সাথেই কাটিয়েছেন। কিন্তু তার পরনে ডায়ানার পোশাক থাকায় বারট্রাম তাকে চিনতে পারেননি। সে রাতে বারট্রাম নিজেই তার হাতে পরিয়ে দিয়েছেন সেই আংটি। হেলেনা বারট্রামকে এও জানাল যে সে তার সন্তানের জননী হতে চলেছে। বারট্রাম যে সে রাতে হেলেনার সাথেই কাটিয়েছেন তা সমর্থন করল। ডায়ানা ও তার মা। সব কথা শোনার পর কাউন্ট আর দ্বিধা না করে বৈধ স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলেন হেলেনাকে।
অ্যাজ ইউ লাইক ইট
অ্যাজ ইউ লাইক ইট
মূল রচনা: উইলিয়াম শেকসপিয়র
পুনর্কথন: মেরি ল্যাম্ব
অনুবাদ: অর্ণব দত্ত
সেকালের ফ্রান্স বিভক্ত ছিল একাধিক প্রদেশে (যেগুলিকে বলা হত ডিউক-শাসিত রাজ্য)। এমনই এক প্রদেশ শাসন করতেন জনৈক প্রবঞ্চক, যিনি তাঁর দাদা তথা রাজ্যের ন্যায়সঙ্গত শাসককে বলপূর্বক উচ্ছেদ করে মসনদ দখল করেছিলেন।
স্বরাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে উক্ত ডিউক জনাকতক বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন আর্ডেনের বনে। সহমর্মী স্বেচ্ছানির্বাসিত এই সব বন্ধুদের নিয়ে সেই বনেই বাস করছিলেন মহান ডিউক। আর তাঁদের জমি ও রাজস্বভাগ ভোগদখল করে ফুলে ফেঁপে উঠছিলেন সেই প্রবঞ্চক। ধীরে ধীরে বনের সরল নিরুদ্বেগ জীবনযাত্রা রাজোচিত জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানবহুল জীবনযাত্রার তুলনায় প্রিয়তর হয়ে উঠল তাঁদের কাছে। তাঁরা বসবাস করতে লাগলেন সেকালের ইংল্যান্ডের রবিন হুডের মতো। রোজই রাজসভার কোনো না কোনো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আসতেন বনে। নিরুদ্বেগে কাটিয়ে যেতেন কিছুটা সময়। তাঁদের কাছে সেই সময়টুকু মনে হত সুবর্ণযুগ। গ্রীষ্মে প্রকাণ্ড বুনো গাছের শীতল ছায়ায় শুয়ে থাকতেন তাঁরা। খেলা করতেন বুনো হরিণের সঙ্গে। বনের এই অবলা হরিণগুলিকে তাঁরা এত ভালবাসতেন যে, খাদ্যের প্রয়োজনে এগুলিকে হত্যা করতে খুব কষ্ট হত তাঁদের। শীতের হিমেল বাতাস ডিউককে তাঁর দুর্ভাগ্যের কথা স্মরণ করিয়ে যেত। তিনি সহ্য করতেন। ধৈর্য ধরতেন। বলতেন, “এই যে হিমেল হাওয়া আমার শরীরে কাঁপন ধরাচ্ছে, এরাই আমার সত্যিকারের সভাসদ। এরা চাটুকথা বলে না। সত্যি কথা বলে প্রতিনিয়ত আমাকে আমার প্রকৃত অবস্থাটা দেখিয়ে দেয়। এরা কামড় বসায় তীক্ষ্ণ দাঁতে। কিন্তু সে দাঁত এদের অকৃতজ্ঞের দাঁত নয়। মানুষ দুর্ভাগ্য চায় না। কিন্তু দুর্ভাগ্য মানুষকে কতই না অমূল্য সম্পদ দিয়ে যায়। অশুভের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে শুভ। যেমন গরল থেকেও পাওয়া যায় জীবনদায়ী ওষুধ, অমৃত।” সবকিছু থেকেই একটা না একটা নীতিবাক্য ঠিক টেনে বার করতেন ডিউক। এই জনহীন বনের সব কিছুই তাঁর চোখে মঙ্গলময় ঠেকত। তাই তিনি গাছের মধ্যে খুঁজে পেতেন ভাষা, বহমান সোঁতার মধ্যে খুঁজে পেতেন পুথি, পাথরের মধ্যে দেখতেন উপদেশমালা আর সব কিছুর মধ্যে পেতেন পরম ভালকে।