তারপর সে সবাইকে জানাল সে পুরুষ নয়, পুরুষের ছদ্মবেশে এক যুবতি নারী, নাম ভায়োলা। তার দূত সিজারিও যে আসলে একজন নারী, সে কথা খুব আশ্চর্য হলেন ডিউক। আসলে ডিউক কিন্তু মনে মনে খুবই ভালোবেসে ফেলেছেন ভায়োলাকে। যখন তিনি দেখলেন সেবাস্টিয়ানের সাথে লেডি অলিভিয়ার বাগদান হয়ে গেছে, তখন আর তার পিছনে ছুটে কোনও লাভ নেই। তার চেয়ে ভায়োলার মতো একজন নারীরত্নকে বিয়ে করে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া শ্রেয়।
ভায়োলার দিকে তাকিয়ে ডিউক বললেন, ভায়োলা! তুমি কি আমায় ভালোবাস?
ডিউকের কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেল ভায়োলা। সে কিছু না বলে চুপ করে রইল।
ডিউক আবার জিজ্ঞেস করলেন তাকে, ভালোয়া! তুমি আমায় বিয়ে করতে রাজি আছ?
লজ্জায় আর যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না ভায়োলা। কোনও মতে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল সে।
এবার জাঁকজমকের সাথে একই দিনে হয়ে গেল দুটি বিয়ে। এই বিয়ের আনন্দ-উৎসব উপলক্ষে ডিউক মুক্তি দিলেন ক্যাপ্টেন অ্যান্টনিওকে।
দ্য উইন্টার’স টেল
দ্য উইন্টার’স টেল
মূল রচনা: উইলিয়াম শেকসপিয়র
পুনর্কথন: মেরি ল্যাম্ব
অনুবাদ: অর্ণব দত্ত
সিসিলির রাজা লিওন্টেস তাঁর সুন্দরী সতীসাধ্বী রানি হারমায়োনিকে নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছিলেন। লিওন্টেস তাঁর এই মহতী রানিটিকে খুবই ভালবাসতেন। জীবনে তাঁর কিছুরই অভাব ছিল না। কেবল মাঝে মাঝে বাল্যবন্ধু তথা সহপাঠী বোহেমিয়ার রাজা পলিজেনাসকে আরেকবার দেখার এবং তাঁকে স্ত্রীর সামনে উপস্থিত করার ইচ্ছে জাগত লিওন্টেসের মনে। দু’জনে একসঙ্গে বড়ো হয়েছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর উভয়কেই নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে রাজকার্য হাতে তুলে নিতে হয়। তাই অনেকদিন তাঁদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ ছিল না। তবে ঘন ঘন তাঁরা পরস্পরের মধ্যে উপঢৌকন, চিঠিপত্র ও রাজদূত আদানপ্রদান ঠিকই করতেন।
অনেক অনুরোধের পর অবশেষে একদিন বোহেমিয়া থেকে সিসিলির রাজসভায় এসে লিওন্টেসের সঙ্গে দেখা করলেন পলিজেনাস।
তাঁর আগমনে লিওন্টেস তো দারুণ খুশি হলেন। রানির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন ছেলেবেলার বন্ধুর। তাঁর সুখ যেন পূর্ণতা লাভ করল প্রিয় বন্ধুর মিলনে। তাঁরা পুরনো দিনের স্মৃতিচারণা করতে লাগলেন। হারমায়োনিকে বলতে লাগলেন তাঁদের পাঠশালার কথা, তাঁদের ছেলেবেলার দুষ্টুমির কথা। হারমায়োনিও তাঁদের কথা শুনে খুব আনন্দ পেলেন।
এইভাবে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে পলিজেনাস ঘরে ফেরার তোড়জোড় শুরু করলেন। তখন স্বামীর ইচ্ছানুসারে হারমায়োনি পলিজেনাসকে আরও কিছুদিন থেকে যেতে অনুরোধ করলেন।
আর তারই ফলে ঘনিয়ে এল হারমায়োনির দুঃখের দিন। পলিজেনাসকে থেকে যেতে অনুরোধ করেছিলেন লিওন্টেসও। তাঁর অনুরোধ পলিজেনাস ফিরিয়ে দিলেও, হারমায়োনির মধুর বাক্যের উত্তরে না বলতে পারলেন না তিনি। যাত্রার দিন পিছিয়ে দিলেন আরও কিছুদিন। তার ফলে এক বেয়াড়া ঈর্ষা এসে জুটল। ভেসে গেল লিওন্টেসের এতকালের ন্যায়পরায়ণতা, আদর্শবোধ, বন্ধুপ্রীতি, পত্নীপ্রেম সব। স্বামীর মন রাখতে পলিজেনাসের সেবাযত্নের ভার নিয়েছিলেন হারমায়োনি। অথচ রাজার ঈর্ষা তা দেখে বেড়েই চলল। লিওন্টেস ছিলেন এক সত্যিকারের বন্ধু, এক পত্নীনিষ্ঠ স্বামী; হলেন এক অমানবিক দানব। তাঁর রাজসভায় ক্যামিলো নামে এক লর্ড ছিলেন। তাঁকে ডেকে রাজা জানালেন নিজের সন্দেহের কথা। ক্যামিলোকে আদেশ করলেন, যেন বিষ দিয়ে পলিজেনাসকে হত্যা করা হয়।
ক্যামিলো ছিলেন সজ্জন ব্যক্তি। তিনি জানতেন, লিওন্টেসের এই সন্দেহ সম্পূর্ণ অমূলক। তাই পলিজেনাসকে বিষ দেওয়ার বদলে তাঁর কাছে গিয়ে প্রভুর আদেশের কথা খুলে বললেন ক্যামিলো। দু’জনে স্থির করলেন, তাঁরা সিসিলি রাজ্যের বাইরে পালিয়ে যাবেন। তারপর ক্যামিলোর সাহায্যে পলিজেনাস নিরাপদে তাঁর নিজের রাজ্য বোহেমিয়ায় ফিরে এলেন। সেখানেই বসবাস শুরু করলেন ক্যামিলো। অলংকৃত করলেন ক্যামিলোর রাজসভা। পরিণত হলেন পলিজেনাসের প্রধান মিত্র তথা প্রিয়পাত্রে।
এদিকে পলিজেনাসের পলায়নের সংবাদ লিওন্টেসের ঈর্ষা আরও বাড়িয়ে তুলল। তিনি চললেন হারমায়োনির মহলের দিকে। রানি তখন তাঁর শিশুপুত্র ম্যামিলিয়াসকে সঙ্গে নিয়ে বসেছিলেন। মাকে খুশি করতে ম্যামিলিয়াস তাঁর একটি ভাল-লাগা গল্প শোনাবার উপক্রম করছিল। এমন সময় কক্ষে ঢুকলেন রাজা। ছেলেকে সরিয়ে নিয়ে রানিকে নিক্ষেপ করলেন কারাগারে।
ম্যামিলিয়াস ছিল নেহাত শিশু। কিন্তু মাকে সে খুব ভালবাসত। মাকে অসম্মানজনকভাবে কারাগারে নিক্ষেপ করা হল দেখে সে মনে খুব ব্যথা পেল। আহারনিদ্রা থেকে তার রুচি গেল চলে। স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ল। খুব রোগা হয়ে গেল সে। সবাই ভাবল দুঃখে বুঝি মারাই যাবে ম্যামিলিয়াস।
রানিকে কারাগারে নিক্ষেপ করার পর লিওন্টেস ক্লিওমেনস ও ডিওন নামে দুই সিসিলিয়ান লর্ডকে পাঠালেন ডেলফোসে – রানি অবিশ্বাসিনী কিনা, সে কথা অ্যাপোলোর মন্দিরের ওরাকল থেকে তা যাচাই করে আসার জন্য।
এদিকে কারাগারে রানি এক শিশুকন্যার জন্ম দিলেন। ভারি শান্তি পেলেন তিনি মনে সেই ফুটফুটে মেয়েটিকে দেখে। বললেন, “ওরে আমার ছোট্ট বন্দিনী সোনা, আমিও যে তোর মতোই নিষ্পাপ!”
হারমায়োনির সখি ছিলেন সিসিলিয়ান লর্ড অ্যান্টিগোনাসের স্ত্রী পলিনা। দয়াময়ী মহতী এক নারী ছিলেন তিনি। প্রভুপত্নী কারাগারে একটি শিশুর জন্ম দিয়েছেন শুনেই তিনি ছুটে গেলেন সেখানে। রানির পরিচর্যা করত এমিলিয়া নামে এক দাসী। পলিনা তাকে বললেন, “দোহাই এমিলিয়া, মহারানিকে গিয়ে বলো যে, তিনি যদি আমার উপর বিশ্বাস রেখে মেয়েটিকে আমার হাতে দেন, তাহলে আমি তাকে তার বাবার কাছে নিয়ে যাই। হয়ত এই নিষ্পাপ শিশুটিকে দেখে তাঁর মন গলে যাবে।” এমিলিয়া বললে, “আমি এক্ষুনি গিয়ে বলছি, ঠাকরুন। মহারানি আজই জিজ্ঞাসা করছিলেন, তাঁর কোনো সই মেয়েটাকে মহারাজের কাছে নিয়ে যেতে প্রস্তুত কিনা।” পলিনা বললেন, “আর তাঁকে বোলো, আমি তাঁর সপক্ষে মহারাজের সামনে সওয়াল করব।” এমিলিয়া বললে, “আপনি মহারানির জন্য কত করছেন। ভগবান আপনার ভাল করুন।” এমিলিয়া গেল হারমায়োনির কাছে। হারমায়োনি সানন্দে মেয়েকে ছেড়ে দিলেন পলিনার তত্ত্বাবধানে। তাঁর ভয় ছিল, কেউই বোধহয় মেয়েটিকে তার বাবার কাছে নিয়ে যেতে রাজি হবে না।