তুমি ঠিক লোককেই বেছে নিয়েছ হেলেনা–বললেন সম্রাট। তারপর বারট্রামের দিকে চেয়ে তিনি বললেন, কাউন্ট বারট্রাম, এবার তুমি স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা হেলেনাকে।
আমায় মাফ করবেন সম্রাট, বললেন কাউন্ট বারট্রাম, আমি ফ্রান্সের এক অভিজাত বংশের ছেলে, রুসিলনের কাউন্ট। আর হেলেনা এক সাধারণ ঘরের মেয়ে। বংশকৌলিন্য বলে ওর কিছু নেই। ও দেখতে সুন্দরী, অনেক গুণ আছে ওর–তা সত্ত্বেও ওকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ওকে বিয়ে করলে অভিজাত সমাজে আমার মাথা নিচু হয়ে যাবে।
গভীর স্বরে সম্রাট বললেন, দেখ, কাউন্ট বারট্রাম! তুমি অভিজাত বংশের ছেলে হলেও আমার অধীনস্থ এক সামস্ত রাজা ছাড়া আর কিছু নও। এ কথা মনে রেখ রাজা কখনও তার প্ৰজার অবাধ্যতা সহ্য করে না। আর তার সাথে এটাও জেনে রাখা সম্রাট হিসেবে অধীনস্থ সমস্তরাজার পাত্রী নির্বাচনের অধিকার আমার আছে। সেই অধিকার অনুযায়ী আমি তোমায় আদেশ দিচ্ছি হেলেনাকে তুমি স্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে।
এরপর বারট্রাম সাহস পেলেন না সম্রাটের আদেশ অগ্রাহ্য করার। পরদিন রাজকীয় সমারোহে গির্জায় তার বিয়ে হয়ে গেল হেলেনার সাথে। সম্রাটের আদেশে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হলেও বারট্রাম যে তাকে মন থেকে মেনে নেয়নি। সে কথা জানতে পেরে হতাশ হল হেলেনা।
এবার হেলেনার থেকে দূরে সরে থাকার এক উপায় খুঁজে বের করলেন বারট্রাম। শত্রুর সাথে মোকাবিলার জন্য ফ্লোরেন্সের ডিউক তার জ্ঞাতিভাই ফরাসি সম্রাটের সাহায্য চেয়েছিলেন। সম্রাট সসৈন্যে বারট্রামকে ফ্লোরেন্সে যাবার অনুমতি দিলেন। যাবার সময় হেলেনাকে ডেকে বারট্রাম বললেন, দ্যাখ, আমি ফ্লোরেন্সে যাচ্ছি যুদ্ধ করতে। কিছুদিন সেখানে আমায় থাকতে হবে। সম্রাটের আদেশেই আমি বাধ্য হয়ে তোমায় বিয়ে করেছি। কিন্তু মনের দিক থেকে তোমায় মেনে নিতে পারছি না।
হেলেনা বলল, তাহলে এখন আমি কী করব?
বারট্রাম বললেন, আমি মাকে একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। তুমি সেটা নিয়ে তার কাছে চলে যাও।
হেলেনা সম্রাটের দুরারোগ্য ব্যাধি সারাতে সক্ষম হয়েছে, বারট্রামের সাথে হেলেনার বিয়ে দিয়েছেন সম্রাট-এ খবর শুনে খুব খুশি হলেন কাউন্টেস। কিন্তু তার চেয়েও বেশি দুঃখ পেলেন যখন শুনলেন হেলেনার সাথে দুর্ব্যবহার করেছে বারট্রাম। মাকে লেখা চিঠিতে বারট্রােম একথাও উল্লেখ করেছেন যে শুধুমাত্র সম্রাটের আদেশেই হেলেনাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে, আর তার থেকে দূরে সরে থাকার জন্য ফ্লোরেন্সে যাচ্ছেন যুদ্ধ করতে। চিঠির শেষাংশে বারট্রাম হেলেনাকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, …যদি কখনও আমার হাতের আঙুল থেকে আংটি খুলে নিতে পার আর আমার সন্তানের জননী হতে পোর, তবেই আমায় স্বামী বলে ডাকার ক্ষমতা পাবে তুমি।
হেলেনাকে সাস্তুনা দিয়ে কাউন্টেস বললেন, তুমি কিছু ভেবো না। আমার ছেলের ব্যবহারের জন্য আমি লজ্জিত। তবে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তোমাকে ছেলের বউ করে আমার শখ তিনি মিটিয়ে দিয়েছেন। বারট্রামের মতো আমিও তোমাকে নিজের সস্তান বলে ভেবে এসেছি। এখন থেকে ছেলের বউ হিসেবে তুমি আগের মতোই আমার কাছে থাকবে। আমার সমস্ত সম্পত্তিতে বারট্রামের মতো তোমারও সমান অধিকার আছে। আমার কথা বিশ্বাস কর হেলেন, আমি বলছি একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু হেলেনা মোটেও আশ্বস্ত হতে পারল না। কাউন্টেসের কথা শুনে। এভাবেই কয়েকদিন কেটে গেল। একদিন সকালে ঘুম ভেঙে হেলেনাকে আর খুঁজে পেলেন না কাউন্টেস। তাকে উদ্দেশ করে লেখা হেলেনার একটি চিঠি তার হাতে তুলে দিল গোমস্তা রোনাল্ডো। সেই চিঠিতে লেখা আছে — মা! আমারই জন্য আপনার ছেলে দেশত্যাগী হয়েছে। সে অপরাধে প্ৰায়শ্চিত্ত করতে আমি খালি পায়ে যাচ্ছি সেন্ট জ্যাকুইসে তীৰ্থ করতে। দয়া করে এ খবরটা আপনার ছেলেকে জানাবেন। অনুগ্রহ করে আপনি আমায় ভুল বুঝবেন না। বাবার মৃত্যুর পর আপনি আমায় আশ্রয় দিয়ে যে উপকার করেছেন তার জন্য আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম। ইতি —
হতভাগিনী হেলেনা।
ডিউকের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে ফ্লোরেন্সের যুদ্ধে বারট্রাম জয়লাভ করলেন। মায়েরচিঠি পেয়ে তিনি জানতে পারলেন তাদের প্রাসাদ ছেড়ে চলে গেছে হেলেনা। তিনি নিশ্চিন্ত হলেন এই ভেবে যে আপদ বিদেয় হয়েছে। এরপর তিনি রুসিলনে ফেরার আয়োজন করতে লাগলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে হেলেনা যে ফ্লোরেন্সে এসে পৌঁছেছে সে খবর তখনও পর্যন্ত জানতেন না। তিনি! সেন্ট জ্যাকুইসে তীর্থযাত্রা করতে হলে ফ্লোরেন্সের মাঝ দিয়েই যেতে হয়। ফ্লোরেন্সে এসে এক বিধবা মহিলার কাছে আশ্রয় নিল হেলেনা। পরদিন সেই তাকে নিয়ে গেলেন ডিউকের সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ দেখাতে। সেনাবাহিনীর পুরোভাগে বারট্রামকে দেখে চমকে উঠল হেলেনা।
বারট্রামের সাথে তার পরিচয় করিয়ে বিধবা ভদ্রমহিলা হেলেনাকে বললেন, ইনি কাউন্ট বারট্রাম। নবপরিণীতা স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে সরে থাকার জন্য ইনি ফ্রান্স থেকে ফ্লোরেন্সে এসেছেন। লড়াই করতে। ভদ্রমহিলার কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল হেলেনা। ভদ্রমহিলা বলেই চললেন, আমার মেয়েকে কাউন্ট বারট্রাম খুবই ভালোবাসেন। কিন্তু তিনি বিবাহিত হবার দরুন আমার মেয়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব করতে পারছেন না। আগামী কালই তিনি দেশে চলে যাবেন। তাই উনি চাইছেন আজ রাতে মেয়ের সাথে দেখা করতে। কিন্তু আমার মেয়ে তাকে মোটেও পছন্দ করে না। সে রাজি নয় তার সাথে দেখা করতে।