অচেনা অজানা এক ব্যক্তির মুখে সেবাস্টিয়ানের নাম শুনে ভায়োলা বুঝতে পারল তার ভাই সেবাস্টিয়ান এখনও বেঁচে আছে আর এই লোকটি তাকে জানে। সে ভায়োলাকেই সেবাস্টিয়ান বলে ধরে নিয়েছে। যাই হোক, ভাইয়ের বেঁচে থাকার কথা শুনে স্বস্তি পেল ভায়োলা। কিন্তু টাকার থলির ব্যাপারটা বোধগম্য হল না। তার কাছে। রক্ষীদের হাতে বন্দি লোকটিকে সে বলল, আমি আপনার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ—কারণ বিপদের সময় আপনি এগিয়ে এসেছেন আমায় বঁচাতে। কিন্তু আপনার টাকার থলির ব্যাপারটা সত্যিই আমি জানি না। তবে আমার কাছে খুবই সামান্য টাকা আছে। প্রয়োজন হলে আপনি তা নিতে পারেন–এই বলে নিজের টাকার থলিটা এগিয়ে দিল তার সামনে।
চেঁচিয়ে বলে উঠলেন ক্যাপ্টেন অ্যান্টনিও, ছিঃ সেবাস্টিয়ান! আমার জানা ছিল না তুমি এত নীচ, বেইমান! জাহাজ ডুবির পর আমি তোমায় প্রাণ বঁচিয়ে আশ্রয় দিয়েছিলাম নিজের কাছে। আর এভাবে তুমি প্রতিদান দিলে তার? অস্বীকার করলে আমাদের বন্ধুত্বকে? আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন, কিন্তু তার আগেই রক্ষীরা টানতে টানতে টেনে নিয়ে গেল তাকে। এখানে থাকলে পাছে স্যার অ্যাণ্ডু তার উপর চড়াও হয়, এই ভয়ে ভায়োলা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ডিউকের প্রাসাদের দিকে।
স্যার অ্যাণ্ডু, স্যার টোবি, দু-জনের কেউই টের পাননি ভায়োলার চলে যাওয়া। কিছুক্ষণ বাদে হঠাৎ সেখানে এসে হাজির সেবাস্টিয়ান–উভয়েই তাকে ধরে নিল সিজারিও বলে। স্যার টোবি ইঙ্গিত করতেই তলোয়ার উচিয়ে তার দিকে ছুটে এল স্যার অ্যাভূ-সেবাস্টিয়ানের কোমরেও বুলিছিল তলোয়ার। শয়তানের মতো দেখতে বদখত চেহারার একটা লোক তার দিকে তলোয়ার হাতে তেড়ে আসছে দেখে সেবাস্টিয়ানও বের করল তার তলোয়ার, মোক্ষম একটা আঘাত হািনল স্যার অ্যাভুর মুখে। বন্ধুকে আহত হতে দেখে স্যার টোবিও ছুটে এল তলোয়ার হাতে–সেও জখম হল সেবাস্টিয়ানের তলোয়ারের আঘাতে।
কাছেই ছিল লেডি অলিভিয়ার প্রাসাদ। খবর পেয়ে তিনি নিজে এলেন সেখানে। আহত স্যার টোবি ও স্যার অ্যাভূ-দু-জনকেই ধমকে-ধামকে তাড়িয়ে দিলেন। রক্ষীদের আদেশ দিলেন তারা যেন উভয়ের কাউকে প্রাসাদে প্রবেশ করতে না দেয়। এবার সিজারিও ভেবে তিনি সেবাস্টিয়ানকে আহ্বান জানালেন প্ৰসাদের ভেতরে আসার। লেডি অলিভিয়ার মতো এক অপরূপ সুন্দরী মহিলার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারল না সেবাস্টিয়ান। তার মতো একজন সাধারণ মানুষের প্রতি মহিলার অপরিসীম দয়া দেখে মনে মনে খুবই অবাক হল সেবাস্টিয়ান। সে লক্ষ করল। মহিলা তার সাথে এমনভাবে কথা বলছেন যেন সে তার পূর্বপরিচিত। সে আরও লক্ষ করল। মহিলা শুধু কথাই বলছেন না। –কথার মাঝে রয়েছে প্ৰেম নিবেদনের সুর। তবে কি মহিলা পাগল? শুরুতে এ প্রশ্নটা জেগেছিল তার মনে। কিন্তু যখন সে দেখল তিনি স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বলছেন, নির্দেশ দিচ্ছেন কাজের লোকদের– তখন সে বুঝতে পারল উনি পাগল নন, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তখন সেও এমন আচরণ করতে লাগল। যাতে লেডি অলিভিয়ার মনে হল সত্যিই এবার নম্র হয়েছে সিজারিওর মন–সে সাড়া দিচ্ছে তার প্রেমের ডাকে। এ সব দেখে খুবই খুশি হলেন লেডি অলিভিয়া। পাছে সিজারিও বেহাত না হয়ে যায়, এই ভয়ে তিনি তখনই তার সাথে বাগদান পর্বটা সেরে রাখতে চাইলেন। সেও রাজি হয়ে গেল তার প্রস্তাবে। আর দেরি না করে লেডি অলিভিয়া তাকে সোজা নিয়ে গেল গির্জায় — সেখানে পাদ্রির সামনে সম্পন্ন হল বিয়ের বাগদান পর্বটা। এবার ভাবী স্বামীকে নিয়ে লেডি অলিভিয়া প্রাসাদে ফিরে এলেন। খাওয়া-দাওয়া সেরে গল্প-গুজব করে কেটে গেল কিছুটা সময়। এ সময় হঠাৎ ক্যাপ্টেন অ্যান্টনিওর কথা। তিনি বলেছিলেন সরাইখানায় অপেক্ষা করবেন তার জন্য। এতক্ষণ নিশ্চয়ই তিনি সেখানে বসে চিন্তা করছেন তার পথ চেয়ে। সরাইখানায় যাবার জন্য সে বিদায় নিয়ে এল লেডি অলিভিয়ার কাছ থেকে। যেতে যেতে সে ভাবতে লাগল তার মতো একজন সাধারণ মানুষকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে অজানা-অচেনা রূপবতী এক ধনী মহিলা তার সাথে বিয়ের বাগদান অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছেন–প্রিয় বন্ধু ক্যাপ্টেনকে নিজ মুখে এ সব কথা বলে সে অবশ্যই তার সাহায্য চাইবে।
প্রাসাদে পৌঁছে ডিউককে অভিবাদন জানিয়ে বলল ভায়োলা, আমায় মাফ করবেন মাননীয় ডিউক। আমার শত চেষ্টা সত্ত্বেও লেডি অলিভিয়া কিছুতেই রাজি হননি। আপনার কথা শুনতে।
এ কথা শুনে বললেন ডিউক, আর তোমায় যেতে হবে না সিজারিও। এবার আমি নিজেই যাব তার সাথে কথা বলতে।
সিজারিও-বেশী ভায়োলা আর কয়েকজন রক্ষীকে সাথে নিয়ে লেডি অলিভিয়ার সাথে দেখা করতে চললেন ডিউক অর্সিনো। প্রাসাদের সামনে তার সাথে দেখা হল রক্ষীদের হাতে বন্ধু অ্যান্টনিওর সাথে। অ্যান্টনিওকে দেখিয়ে ভায়োলা বলল, কিছুক্ষণ আগে এই ভদ্রলোকই আমায় রক্ষা করেছেন দ্বন্দ্বযুদ্ধের হাত থেকে।
অবাক হয়ে ডিউক বললেন, দ্বন্দ্বযুদ্ধ? কিছুই তো বুঝতে পারছি না। আমি?
তখন ভায়োলা তাকে খুলে বলল সব কথা। শেষমেশ বলল ধরা পড়ার পর উনি একটা টাকার থলে চেয়েছিলেন তার কাছে। কিন্তু ও ব্যাপারে কিছুই জানে না সে।
এবার ক্যাপ্টেন বললেন, ছিঃ ছিঃ এমন অধঃপতন হয়েছে তোমার। এখনও না বোঝার ভান করছ?–বলেই ইশারায় ভায়োলাকে দেখিয়ে ডিউককে বললেন, মাননীয় ডিউক, জাহাজ ডুবির পর আমি ওকে জল থেকে তুলে নিয়ে এসেছিলাম আমার জাহাজে। আশ্রিত হিসেবে কয়েকমাস আমার জাহাজে কাটিয়েছে। ও। আমার জাহাজ আজই এসে পৌঁছেছে ইলিরিয়ার বন্দরে। শহর দেখতে যাবার সময় আমি ওর হাতে তুলে দিয়েছিলাম এক থলে স্বর্ণমুদ্রা। ওর ফিরতে দেরি দেখে ধরা পড়ার ঝকি সত্ত্বেও আমি নেমে এসেছি। ডাঙায়। কিছুদূর যাবার পর দেখতে পেলাম ও দ্বন্দ্বযুদ্ধ করছে এক আধাবুড়ো মাতালের সাথে। ভয় আর উত্তেজনায় তলোয়ার সুন্ধু ওর হাতটা থর থর করে কঁপিছে। তলোয়ারটা হয়তে ওর হাত থেকে পড়েই যেত যদি না আমি এগিয়ে এসে ওর হয়ে লড়াই করতে নামতাম। এমন কপাল আমার! ঠিক সে সময় আপনার রক্ষীরা এসে গ্রেপ্তার করলে আমাকে। আর এখন কিনা ও বলছে চেনেই না। আমাকে। আগে কখনও দেখেনি আমায়। তাই টাকার থলেও নেই তার কাছে। হুজুর! আমার প্রার্থনা এই বেইমানির বিচার আপনি নিজেই করুন।