ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে উঠতে লাগল। তারা। যৌবনে পা দিয়ে একদিন তারা চেপে বসােল এক যাত্রীবাহী জাহাজে–গন্তব্যস্থল ইলিরিয়া। স্বাভাবিকভাবে কেটে গেল পুরো দু-দিন দু-রাত। তৃতীয় দিন ইলিরিয়ার উপকূলে এসে পৌঁছাল তাদের জাহাজ। সন্ধের পর আকাশের এক কোণে দেখা গেল একটুকরো ঘন কালো মেঘ। থমথমে হয়ে গেল অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন আর মাঝি-মাল্লাদের মুখ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে কালো মেঘ দৈত্যের মতো ফুলে-ফোঁপে উঠে ছেয়ে ফেলল। সারা আকাশ –মুহূর্তের মধ্যে শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি। মনে হল ঝড়ের দাপটে উড়ে যাবে গোটা জাহাজটা। অনেক কষ্টে মাঝি-মাল্লাদের সাহায্যে জাহাজটা নিয়ন্ত্রণে রাখলেন ক্যাপ্টেন। এবার সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠল ঝড়-বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে। পাহাড়ের মতো উচু উঁচু ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল জাহাজের উপর। প্রচণ্ড ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙে গেল জাহাজের মাস্তুল, ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল পোল। মাঝি-মাল্লা আর যাত্রীদের নিয়ে অসহায়ভাবে জাহাজটা দুলতে লাগল ঢেউয়ের মাথায় ইলিরিয়ার তীরবতী হবার পর জাহাজটিকে আর বাঁচীন সম্ভব হল না। ক্যাপ্টেনের পক্ষে। ডুবে গেল জাহাজটা। অধিকাংশ মাঝি-মাল্লা আর যাত্রীরা জাহাজের সাথেই তলিয়ে গেল সমুদ্রের অতলে। ক্যাপ্টেন আর সামান্য কজন মাঝি-মাল্লার সাথে ছোটো একটা নৌকায় উঠে কোনও মতে প্ৰাণ বাঁচোল ভায়োলা। তীরে উঠেই তার মনে প্রশ্ন জাগল ভাই সেবাস্টিয়ান বেঁচে আছে কিনা।
সে জিজ্ঞেস করল ক্যাপ্টেনকে, আমার ভাই সেবাসিন্টয়ান কি বেঁচে আছে?
তাকে আশ্বস্ত করে ক্যাপ্টেন বললেন, সম্ভবত সে বেঁচে গেছে। জাহাজ ডুবির সময় লক্ষ করেছিলাম। সে একটা মাস্তুলের সাথে নিজেকে বেঁধে নিয়েছে। মনে হয়, সমুদ্রের ঢেউই তাকে তীরে এনে ফেলেছে। আশা করি, ঈশ্বরের কৃপায় সে ভালোই আছে।
ক্যাপ্টেনের কাছে জানতে চাইল ভায়োলা, আপনি কি এ জায়গাটা চেনেন?
সেটা এখান থেকে তিন ঘণ্টার পথ। ক্যাপ্টেনের কথা শুনে কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করল ভায়োলা।
এবার ভাবনা এল ভায়োলার মনে; সাথে তো টাকা-কড়ি মোটেও নেই। এই বিদেশ-বিভূইয়ে কোথায় বা যাবে সে আর কেই বা তাকে সাহায্য করবে! একমাত্র ভাই-ই ছিল তার আশা-ভরসা। সে আদপে বেঁচে আছে কিনা আর বেঁচে থাকলেও সে কোথায় আছে তা জানে না! ভায়োলা। কাজেই নিজের ব্যবস্থা যে নিজেকেই করতে হবে তা স্পষ্ট বুঝতে পারল সে। দেশে ফিরে যাবার ব্যবস্থাও করতে হবে তাকেই। কিন্তু এই অজানা জায়গায় কে দেবে তাকে চাকরি? কী করে অর্থে পার্জন করবে। সে? তদুপরি সে একজন যুবতি মেয়ে। কাজের ধান্দায় রাস্তার বেরুলে অন্যরকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা থেকে যায়।
সে ক্যাপ্টেনের কাছে জানতে চাইল, কে এই দেশের শাসক?
ক্যাপ্টেন উত্তর দিলেন, ডিউক অর্সিনো।
ভায়োলা জানতে চাইল, তিনি কী ধরনের লোক?
ক্যাপ্টেন বলল, সৎ বলতে আমরা যা বুঝি, ডিউক সে ধরনের খাটি সৎ লোক। বয়সে যুবক হলেও এখনও পর্যন্ত বিয়ে হয়নি। তিনি ভালোবাসেন অলিভিয়া নামে একজন ভদ্রমহিলাকে। কাছেই বাড়ি ভদ্রমহিলার। তিনি ডিউককে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে তাকে বিয়ে করতে আদৌ ইচ্ছক নন তিনি। কিন্তু তাতেও দমে যাননি ডিউক। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন অলিভিয়া ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে রাজি নন তিনি।
ক্যাপ্টেনের কাছে জানতে চাইল ভায়োলা, অলিভিয়া কে?
ক্যাপ্টেন বললেন, সে এক সম্রাস্ত বংশীয় কাউন্টের মেয়ে। প্রায় একবছর হল মৃত্যু হয়েছে তাঁর বাবার। এরপর তার অভিভাবক হন তার দাদা। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তার দাদাও মারা গেলেন। ভাইয়ের এই মৃত্যুতে প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছেন তিনি। নিজেও বাইরে বের হন না। আর কেউ এলে তার সাথে দেখাও করেন না।
অলিভিয়াকে চাক্ষুষ না দেখলেও তার বড়ো ভাইয়ের অকালমৃত্যুর কথা শুনে তার প্রতি সমবেদনা জাগলো ভায়োলার মনে। সাথে সাথে তার মনে এল ছোটো ভাই সেবাস্টিয়ানের কথা। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, লেডি অলিভিয়ার অবস্থা দেখছি আমারই মতো। উনি হারিয়েছেন তার দাদাকে আর আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার ছোটো ভাইকে, জাহাজ ডুবির ফলে যে নিখোঁজ হয়েছে।
সায় দিয়ে ক্যাপ্টেন বললেন, সে দিক দিয়ে বিচার করলে তোমাদের দু-জনের অবস্থা প্ৰায় সমান।
ভায়োলা জানতে চাইল, আপনার কাছেই শুনলাম লেডি অলিভিয়া নাকি অগাধ ধন-সম্পত্তির মালিক। উনিই পারেন আমায় চাকরি দিতে। আপনি যদি একটু চেষ্টা করেন তাহলে হয়তো হয়ে যেতে পারে আমার একটা চাকরি।
সে না হয়। আমি চেষ্টা করব, তবে আশা কম–বললেন ক্যাপ্টেন।
ক্যাপ্টনকে মিনতি জানিয়ে ভায়োলা বলল, কিন্তু টাকা রোজগারের ব্যবস্থা আমায় যে ভাবেই হোক করতে হবে। লেডি অলিভিয়া না রাজি হলে আপনিই বরঞ্চ অনুরোধ করে দেখুন ডিউক অর্সিনোকে।
ভায়োলার কাকুতি-মিনতি শুনে ক্যাপ্টেন রাজি হয়ে গেলেন তার চাকরির জন্য ডিউককে অনুরোধ করতে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্যদিকে–ডিউক কি রাজি হবেন ভায়োলার মত এক সুন্দরী যুবতিকে চাকরি দিতে? ব্যাপারটা আঁচ করে ভায়োলা নিজেই সমাধান করল সমস্যার, ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে একপ্রস্থ পোশাক চেয়ে নিয়ে নিজের গায়ে চাপাল সে, তারপর আরশির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে লাগল সে। নিজেকে দেখে মনে হচ্ছিল এ যেন সে নিজে নয়, যমজ ভাই সেবাস্টিয়ানের চেহারাটাই ফুটে উঠেছে আরশিতে। এমনকি ক্যাপ্টেনও অবাক হয়ে গেলেন তাকে ওই পোশাকে দেখে। ক্যাপ্টেন বারবার বলতে লাগলেন যুবতি বলে মনেই হচ্ছে না ভায়েলাকে দেখে। ওই পোশাক পরা অবস্থায় তিনি তাকে ডিউকের কাছে নিয়ে বললেন, এ ছেলেটি আমার খুবই পরিচিত। দারুণ কষ্টের মধ্যে পড়েছে। এ বেচারা। আপনার তো নানারকম কাজ-কর্মের জন্য লোকের প্রয়োজন। দয়া করে, যদি একে একটা কাজ দেন, তাহলে খুবই উপকার হয় বেচারার।