ছোট্ট মটরফুল উত্তর দিল, “এই যে মহাশয়, আমি এখানে।”
“আমার মাথাটা চুলকে দে তো,” বলল ভাঁড়। “লূতাতন্তু কোথায়?”
“এই যে এখানে, মহাশয়,” বলল লূতাতন্তু।
“বাবা লূতাতন্তু,” বোকা ভাঁড়টা বললে, “ওই থিসল পাতার উপর বসা ছোট্ট লাল মৌমাছিটাকে মেরে আমাকে মৌচাকটা এনে দে তো। দেরি করিসনি। আর দেখিস, যেন ভেঙে না যায়। চটকে গেলে আমি কিন্তু খুব কষ্ট পাব। সরষে-বীজ কোথায়?”
“এইখানে, মহাশয়,” বলল সরষে-বীজ। “কী করতে হবে বলুন।”
“কিছুই না,” বলল ভাঁড়, “বাছা সরষে-বীজ, তুই মটরফুল বাবাজিকে আমার মাথা চুলকাতে সাহায্য কর। বাছা সরষে-বীজ রে, মনে হচ্ছে আমাকে এবার নাপিতের কাছে যেতেই হবে। মুখে অনেক চুল গজিয়েছে।”
রানি বললেন, “প্রিয়তম, কী খাবে বলো। আমার এক পরি তোমাকে একপাল কাঠবিড়ালি আর তাজা বাদাম এনে দিতে পারে।”
যার মাথা গাধার, তার ক্ষুদপিপাসাও গাধারই মতো! ভাঁড় বলল, “বরং একমুঠো শুকনো মটর খাই। কিন্তু শোনো, তোমার এই লোকগুলোকে ছুটি দাও। এরা যেন আমাকে বিরক্ত না করে। একটু ঘুমাতে ইচ্ছে করছে।”
রানি বললেন, “ঘুমাও তবে; আমার বাহুতে মাথা রেখে ঘুমাও। আমি হাত দিয়ে তোমায় বাতাস করি। আহা! আমি তোমায় কতই না ভালবাসি! কতই না চাই!”
ভাঁড়টা রানির বাহুতে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে, এমন সময় পরিরাজ চুপিচুপি গিয়ে হাজির হল রানির সামনে।
ভাঁড়টা রানির হাতে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিল। রানি তার গাধামুণ্ড ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। তা অস্বীকার করতে পারলেন না।
ওবেরন রানিকে উপহাস করতে লাগলেন। চুরি করে আনা ছেলেটিকে দাবি করতে লাগলেন। স্বামী তাঁর নয়া প্রেমিকের সন্ধান পেয়ে গেছেন দেখে, টাইটানিয়া পড়লেন মহালজ্জায়। তিনি আর ওবেরনকে প্রত্যাখ্যান করতে সাহস পেলেন না।
এইভাবে অনেকদিন ধরে চাইতে থাকা ছেলেটিকে বালকভৃত্য করার জন্য পেয়ে গেলেন ওবেরন। তখন টাইটানিয়ার অবস্থা দেখে তাঁর দয়া হল। তিনি টাইটানিয়ার চোখে অপর ফুলটির রস বুলিয়ে দিলেন। পরিরানি ফিরে পেলেন তাঁর চেতনা। কী এক অদ্ভুত দৈত্যের প্রেমে তিনি পড়েছিলেন, সেই কথাই বার বার বলতে লাগলেন।
ওবেরন ভাঁড়ের মাথা থেকে গাধার মুণ্ডুখানা সরিয়ে নিলেন। সে তার পুরনো মাথাটা ঘাড়ের উপর নিয়ে বোকাটা বাকি ঘুমটা ঘুমালো।
পূর্ণমিলনের পর ওবেরন টাইটানিয়াকে প্রেমিক-প্রেমিকাদের ইতিকথা আর তাদের ঝগড়ার বৃত্তান্ত শোনালেন। পাক তার আগের ভুল সংশোধন করে নিয়েছিল। সে সবাইকে একে অপরের অজ্ঞাতসারে এক জায়গায় এনে ফেলে পরিরাজের দেওয়া ওষুধের সাহায্যে সযত্নে লাইস্যান্ডারের চোখ থেকে আগের জাদুটি মুছে ফেলেছিল।
প্রথম ঘুম ভাঙল হার্মিয়ার। সে দেখল, তার হারানো প্রেমিক লাইস্যান্ডার তার কাছে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। লাইস্যান্ডার ঘুম থেকে উঠে সর্বাগ্রে দেখল হার্মিয়াকেই। দেখামাত্র পরির জাদুতে সে হার্মিয়ার প্রতি তার হারানো প্রেম ফিরে পেল। তখন সকালে তাদের নৈশ অভিযান নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। ভাবতে লাগল, এই সব সত্যি ঘটেছে, নাকি সবটাই একটা উটকো স্বপ্ন।
হেলেনা ও ডিমেট্রিয়াসেরও ঘুম ভাঙল। রাতে ঘুমিয়ে হেলেনার সব ক্ষোভ মুছে গিয়েছিল। ডিমেট্রিয়াস তখনও তাকে প্রেমনিবেদন করছিল। শুনে হেলেনার ভারি আনন্দ হল। ডিমেট্রিয়াসের কথাগুলি আচমকা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে শুরু করল। তাতে সে অবাক হলেও অখুশি হল না।
সুন্দরীদের মনেও আগের রাতের ঝগড়ার কোনো রেশ রইল না। তারা আবার প্রাণের সইতে পরিণত হল। আগের রাতের সব কড়া কথাগুলি ক্ষমা করে দিল। সবাই একসঙ্গে বসে ভাবতে লাগল, এবার কী করা যায়। তারা ঠিক করল, ডিমেট্রিয়াস হার্মিয়ার উপর থেকে তার দাবি প্রত্যাহার করে নেবে। সে হার্মিয়ার বাপের কাছে গিয়ে হার্মিয়ার উপর থেকে মৃত্যুদণ্ড তুলে নেওয়ার আর্জিও জানাবে। বন্ধুকৃত্য করার জন্য ডিমেট্রিয়াস যখন এথেন্সে ফেরার তোড়জোড় করছে, এমন সময় পলাতকা মেয়ের খোঁজ করতে করতে তাদের কাছে হাজির হলেন হার্মিয়ার বাপ ইজিয়াস।
ইজিয়াস বুঝলেন, ডিমেট্রিয়াস আর তার মেয়েকে বিয়ে করতে চায় না। তখন আর তিনি লাইস্যান্ডার ও হার্মিয়ার বিয়েতে আপত্তি জানালেন না। কিন্তু বললেন, বিয়ে হবে চার দিন পরে। সেই দিনই হার্মিয়ার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। হেলেনাও সেই দিনই তার প্রিয়তম ও অধুনা-বিশ্বস্ত প্রেমিক ডিমেট্রিয়াসের সঙ্গে পরিণয় বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইল।
পরিরাজ ও পরিরানি অদৃশ্য থেকেই তাদের মিলনের সাক্ষী হয়ে রইলেন। দেখলেন তাদের প্রেমকাহিনির মিলনান্তক সমাপ্তি। এই মিলনে তাঁরা এতই খুশি হলেন যে, তাদের বিবাহ উপলক্ষ্যে সারা পরিরাজ্যে উৎসব পড়ে গেল।
এখন শোনো। কারোর যদি পরিদের এই দুষ্টুমি পছন্দ না হয়, কারোর যদি এই সব ঘটনা অবিশ্বাস্য আজগুবি মনে হয়, তাহলে তারা যেন তাদের নিজেদের স্বপ্নগুলির কথা স্মরণ করে। তারাও তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এমনই সব অভিযানের স্বপ্ন দেখে। তাই আশা করব, পাঠকেরা কেউই এই মিষ্টিমধুর নিরীহ চৈতালি রাতের স্বপ্নটিকে মনগড়া ভাববেন না।
টুয়েলফথ নাইট
দুই জমজ ভাই-বোন ভায়োলা আর সেবাস্টিয়ান বাস করত গ্রিসের মেসালিনা শহরে। এত সুন্দর তারা দেখতে যে একবার নজর পড়লে আর চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। দুজনের মধ্যে এত মিল যে পোশাক পরার পর মাঝে মাঝে চেনা যায় না কে ভায়োলা আর কে সেবাস্টিয়ান। দুজনে খুব ছোটোবেলায় হারিয়েছে তাদের বাবা-মাকে। এমন কোনও আপনজন নেই বাড়িতে যে ওদের স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেবে। তাই ওরা নিজেরাই নিজেদেরকে ভালোবাসে। এক মুহূর্ত একে অন্যকে দেখতে না পেলে ছটফট করে ওঠে তারা।