হেলেনা তো হতবাক! সে ভাবল, লাইস্যান্ডার, ডিমেট্রিয়াস ও তার এক সময়কার সই হার্মিয়া মিলে ছক কষে তার পিছনে লেগেছে।
হার্মিয়াও হেলেনার অবস্থা দেখে অবাক। লাইস্যান্ডার ও ডিমেট্রিয়াস – দু’জনেই তখন হেলেনার স্তব করতে ব্যস্ত। হার্মিয়া কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না যে, কিসের টানে দু’জনে এক সঙ্গে হেলেনার দিকে ঝুঁকে পড়ল।
একদা অভিন্ন-হৃদয় সই হার্মিয়া ও হেলেনা পরস্পরকে তখন চোখা চোখা বাক্যবাণে বিদ্ধ করতে লাগল।
হেলেনা বলল, “নির্দয়া হার্মিয়া! তুমিই তোমার প্রেমিক লাইস্যান্ডারকে আমার পিছনে মিথ্যে প্রেম নিবেদন করার জন্য লাগিয়েছ। আর তোমার অপর প্রেমিক ডিমেট্রিয়াস, যে আমাকে লাথি মারতে বাকি রেখেছিল, সে এখন আমাকে বলছে দেবী, জলপরি, দুর্লভ, বহুমূল্য, স্বর্গীয়! কেন? কারণ, তুমিই তাকে পাঠিয়েছ, আমার পিছনে লাগতে! নির্দয়া হার্মিয়া! দু’জন পুরুষমানুষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তোমার এই হতভাগিনী সইয়ের পিছনে লাগতে লজ্জা হয় না তোমার? আমাদের পাঠশালার বন্ধুত্বের কথা ভুলে গেলে? হার্মিয়া, কতদিন আমরা এক আসনে বসে একসঙ্গে গান গাইতাম। একই সুতো দিয়ে মালা গাঁথতাম। জোড়া চেরিফলের মতো বেড়ে উঠেছি আমরা। আমাদের দু’জনকে আলাদা করা যেত না। আর আজ, দু’জন পুরুষমানুষকে হাত করে সইয়ের অপমান করা কী নারীসুলভ কাজ বলে তোমার মনে হয়?”
হার্মিয়া বলল, “বাহ্! তোমার এই মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলি তো আমাকে অবাক করছে! আমি তোমার পিছনে লেগেছি? না তুমি আমার পিছনে লেগেছ?” হেলেনা পালটা বললে, “হ্যাঁ, বলো বলো! সামনে গম্ভীর মুখে আমাকে কড়া কড়া করে বলো, আর আমি পিছন ফিরলেই একে অপরের দিকে চোখ টিপে দাও আর পিছনে লাগার মজা লোটো! শরীরে বিন্দুমাত্র দয়া, মহত্ব, ভদ্রতা থাকলে কী আর আমাকে নিয়ে এমন বিশ্রী খেলা খেলতে পারতে?”
হার্মিয়া আর হেলেনা ঝগড়া করতে লাগল। এদিকে লাইস্যান্ডার আর ডিমেট্রিয়াস তাদের ছেড়ে বনে ঢুকল, লড়াই করে হেলেনাকে জয় করার অভিপ্রায় নিয়ে।
পরে যখন হার্মিয়া আর হেলেনার খেয়াল হল যে ছেলেরা তাদের ছেড়ে গেছে, তখন দু’জনে ঝগড়া থামিয়ে বনের মধ্যে নিজের নিজের প্রেমিকের সন্ধানে ঘুরতে লাগল।
পরিরাজ তাঁর ছোট্ট পাককে নিয়ে তাদের ঝগড়া শুনছিলেন। তারা চলে যেতেই তিনি পাককে বললেন, “এটা হয় তোর দোষ, নয় তোর বদমায়েশি!” পাক বলল, “বিশ্বাস করুন, অন্ধকারের রাজা, ভুল হয়ে গেছে। আপনি বলেছিলেন, এথেন্সীয় পোষাক দেখে ছেলেটিকে চিনতে। আমি তাই দেখেই ভুল করেছি। তবে কিনা, এই ভুলের জন্য একটুও দুঃখিত নই। ওদের ঝগড়াঝাটি দেখে বেশ মজা হচ্ছে।” ওবেরন বললেন, “শুনলি তো, লাইস্যান্ডার আর ডিমেট্রিয়াস মল্লযুদ্ধের উপযুক্ত জায়গা খুঁজতে গেছে। আমার আদেশ রইল, রাত্রিকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে দে। প্রেমিকেরা এই কুয়াশায় পথ হারাক। তারা যেন একে অপরকে খুঁজে না পায়। তুই একজনকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর গলায় ডাক দিবি। তাকে উসকাবি। সে শত্রুর পিছু নিচ্ছে মনে করে তোর পিছু নেবে। ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের ছোটাছুটি করাবি। তারপর তারা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে, লাইস্যান্ডারের চোখে এই অপর ফুলের রসটি ঢেলে দিবি। এতে হেলেনার প্রতি তার আকর্ষণ নষ্ট হয়ে যাবে। আবার সে হার্মিয়ার প্রতি তার পূর্বপ্রেম ফিরে পাবে। মেয়েদুটিও তাদের পছন্দসই পুরুষকে প্রেমিক হিসেবে পাবে। তখন এই সব ঘটনা তাদের স্বপ্ন মনে হবে। আমি যাই। দেখি, টাইটানিয়া আবার কোন মিষ্টি প্রেমিকের প্রেমে পড়ল!”
টাইটানিয়া তখনও ঘুমাচ্ছিলেন। ওবেরন দেখলেন, একটা ভাঁড় বনের মধ্যে পথ হারিয়ে সেখানেই শুয়ে ঘুমাচ্ছে। তিনি বললেন, “এই ছোঁড়াই আমার টাইটানিয়ার প্রেমিক হওয়ার যোগ্য!” এই বলে তিনি চট করে জাদুবলে ভাঁড়ের মাথাটা গাধার মতো করে দিলেন। তার কাঁধের উপর গাধার মাথাটা দারুণ মানিয়ে গেল। তবু কাজটা করার সময় তার ঘুম ভেঙে গেল। ওবেরনের কেরামতি অবশ্য সে ধরতে পারল না। সোজা চলে গেল নিকুঞ্জে, যেখানে পরিরানি ঘুমাচ্ছিলেন।
চোখ খুলতেই সেই ছোট্ট লালচে ফুলের জাদুর বশ হলেন টাইটানিয়া, “অহো, কোথাকার দেবদূত ও? তুমি কী সুন্দর? আচ্ছা, তুমি কী যেমন রূপবান, তেমনই বুদ্ধিমান?”
বোকা ভাঁড় বলল, “কেন, মহাশয়া? আপাতত এই বন থেকে বার হওয়ার পথ বের করার মতো বুদ্ধিটুকু পেলেই চলে যায়!”
মোহগ্রস্থা রানি বলে উঠলেন, “তুমি বনের বাইরে যেতে চেয়ো না। আমি সামান্যা পরি নই। আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি। আমার সঙ্গে এসো। এখন আমার পরিরা তোমার সেবাযত্ন করবে।”
তখন রানি তাঁর চার পরিকে নাম ধরে ডাকলেন। এরা হল মটরফুল, লূতাতন্তু, মথ ও সরষে-বীজ।
রানি বললেন, “এই ভদ্রলোকের সেবা কর। হাঁটার সময় এঁর আগে আগে যা। এঁর চোখের সামনে নৃত্য কর। এঁকে আঙুর আর খুবানি খাওয়া। আর এঁর জন্য মৌচাক ভেঙে মধু চুরি করে আন।” তারপর ভাঁড়কে বললেন, “এসো, আমার পাশে বসো। হে গর্দভ-সুন্দর, আমি তোমার মধুর রোমশ গালদু’টি নিয়ে খেলা করি! হে আমার কোমলানন্দ, এসো, আমি তোমার লম্বা লম্বা কানদুটি চুম্বন করি!”
গর্দভমুণ্ড ভাঁড় পরিরানির প্রেম নিবেদনকে অতটা গ্রাহ্য করল না। নতুন সেবাদাসেদের পেয়ে তার ভারি গর্ব হচ্ছিল। সে জিজ্ঞাসা করল, “মটরফুল, কোথায় আছিস?”