ওবেরন দেখলেন, রানি ঘুমানোর পর কে কী করবে, তার নির্দেশ পরিদের দিয়ে রাখছেন টাইটানিয়া। বলছিলেন, “তোদের মধ্যে কেউ মাস্ক-রোজের কুঁড়ির মধ্যে ঢুকে পোকা মারবি। কেউ বাদুড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে তার চামড়া ছাড়িয়ে আনবি। সেই চামড়ায় আমার ভূতেদের জন্য জামা বানাবি। কেউ নজর রাখবি ওই হুল্লোড়বাজ প্যাঁচাটার উপর। দেখিস, ওর ডাক যেন আমার কানে না আসে। কিন্তু সবার আগে আমাকে একটা গান শোনা।” তখন পরিরা তাকে এই গানটি শোনালো –
তুমি সাপকে জিভ দিয়েছো দু-দু’খানা
কাঁটাচুয়া করেছো গায়েব;
গোসাপ আর কানা-পোকারা, দুষ্টুমি কোরো না,
যাও, যাও, ঘুমান মোদের রানিসাহেব।
ফিলোমেল, ধরো তান,
শোনাও একটা ঘুমপাড়ানি গান
ঘুমপাড়ানি ঘুমপাড়ানি ঘুমপাড়ানি গান
ক্ষতি নয়, জাদু নয়, নয় কোনো মন্তর
মোদের পরিরানির কাছে আসুক নিরন্তর
রাত্রি মনোহরা আর ঘুমপাড়ানি গান।
এই মিষ্টি গানখানি শুনিয়ে পরিরা তাদের রানিকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তারপর চলে গেল যে যার কাজ সারতে। ওবেরন ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন টাইটানিয়ার কাছে। খানিকটা প্রেমরস ঢেলে দিলেন তাঁর চোখে। বললেন –
“নিদ্রাভঙ্গে দেখবে যাকে সবার আগে,
তার সঙ্গে বাঁধা পড়বে প্রেম-অনুরাগে।”
এবার দেখি কী করছে হার্মিয়া। সে তো বাপের কথা অমান্য করে ডিমেট্রিয়াসকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে অটল। তাই মৃত্যুদণ্ড এড়াতে বাড়ি থেকে পালিয়ে বনে এসে দেখল, তাকে মাসির বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে লাইস্যান্ডার। কিন্তু অর্ধেক পথ যেতে না যেতেই ক্লান্তিতে পা অবশ হয়ে এল তার। লাইস্যান্ডার তার খুব যত্ন করত। তাই সে ঠিক করল, সকাল না হওয়া অবধি বনেই বিশ্রাম করবে দু’জনে। নরম ফার্নের উপর শুয়ে হার্মিয়া আর তার কিছুদূরে শুয়ে লাইস্যান্ডার ঘুমিয়ে পড়ল। এমন সময় পাক দেখতে পেল তাদের। প্রভুর কথা মিলিয়ে সে দেখল, এথেন্সীয় পোষাক পরা এক যুবক একটি সুন্দরী মেয়ের কিছুদূরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। একসঙ্গে থাকলেও, দু’জনে শুয়েছিল আলাদা হয়ে। পাক ভাবল, তার প্রভু এদের কথাই বলেছেন তাঁকে। ঘুম থেকে উঠে যুবকটি সবার আগে মেয়েটিকে দেখবে। তাই আর কিছু না ভেবে, তার চোখেই প্রেমসুধারস ঢেলে দিল পাক। কিন্তু হল কী, হার্মিয়ার বদলে লাইস্যান্ডারের চোখে পড়ে গেল হেলেনা। হেলেনা সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। ঘুম ভেঙে তাকে সবার আগে দেখে লাইস্যান্ডারের মন থেকে হার্মিয়ার প্রতি প্রেম গেল উবে। মায়াবলে পড়ল সে হেলেনার প্রেমে।
ঘুম ভেঙে আগে হার্মিয়াকে দেখলে লাইস্যান্ডারকে পাকের এই ভুলের খেসারত দিতে হত না। সে তো আর তার প্রিয়তমাকে বাড়তি ভালবাসতে পারে না। কিন্তু কী আর করা! তার কপালে ছিল, নিজের সত্যিকারের প্রেমিকা হার্মিয়াকে ভুলে বনের মধ্যে মাঝরাতে একা ফেলে অন্য একটি মেয়ের পিছনে ধাওয়া করা!
দুর্ঘটনাটা কীভাবে ঘটল, তা বলি। যেমনটি একটু আগে বলছিলাম, হেলেনা ডিমেট্রিয়াসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছিল। ডিমেট্রিয়াস তো তাকে ফেলেই দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। সেই দৌড়ে তাল মেলাতে পারছিল না হেলেনা। অল্পক্ষণ পরেই ডিমেট্রিয়াস তার দৃষ্টিপথের বাইরে চলে গেল। হতোদ্যম হয়ে একলা ঘুরতে ঘুরতে সে হাজির হল যেখানে লাইস্যান্ডার ও হার্মিয়া ঘুমাচ্ছিল। হেলেনা বলে উঠল, “এ কী! এ যে লাইস্যান্ডার! মাটিতে শুয়ে কেন? ঘুমাচ্ছে? নাকি মারা গেছে?” তারপর তাকে আলতো করে ছুঁয়ে বলল, “দোহাই আপনার, বেঁচে থাকলে চোখ মেলে তাকান।” লাইস্যান্ডার চোখ মেলে চাইল। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল প্রেমরসের জাদু। তক্ষুনি লম্বাচওড়া প্রেমের কথা বলে সে হেলেনার প্রতি প্রেমনিবেদন শুরু করে দিল। বলল, হেলেনার পাশে হার্মিয়াকে মনে হয়, সাদা পায়রার পাশে দাঁড়কাক। বলল, হেলেনাকে পেতে সে আগুনের উপর দিয়ে হাঁটতেও রাজি। আরও কত রকম প্রেমিক-সুলভ ভাষণ দিল সে। হেলেনা জানত, লাইস্যান্ডার তার সই হার্মিয়ার প্রেমিক ও পাণিপ্রার্থী। নিজের সম্পর্কে ওই সব কথা শুনে তার ভারি রাগ হল। ভাবল, লাইস্যান্ডার তাকে নিয়ে মজা করছে। বলেই ফেলল, “হায়! কেন জন্মালাম আমি? সকলের উপহাসের পাত্রী হওয়ার জন্য? ডিমেট্রিয়াস আমার দিকে তাকায় না। ভাল করে কথাও বলে না। সেটাই কী যথেষ্ট নয়? সেটাই কী যথেষ্ট নয় যে আপনি মশাই উড়ে এসে আমার সঙ্গে এই রকম অপমানকর খেজুরে প্রেমালাপের নাটক জুড়ে দিলেন? লাইস্যান্ডার, আপনাকে আমি ভদ্রলোক মনে করেছিলাম!” রাগে মাথায় কথাগুলি ছুঁড়ে দিয়েই জোরে হাঁটা দিল হেলেনা। লাইস্যান্ডার ঘুমন্ত হার্মিয়াকে পিছনে ফেলে পিছু নিল তার।
ঘুম থেকে উঠে নিজেকে একা দেখে খুব ভয় পেয়ে গেল হার্মিয়া। সে বনের মধ্যে ঘুরতে লাগল। সে তো জানত না যে, লাইস্যান্ডারের কী হয়েছে বা কোথায় গেলে সে তার দেখা পাবে। এদিকে ওবেরন দেখলেন, হার্মিয়া ও প্রতিদ্বন্দ্বী লাইস্যান্ডারকে খুঁজে না পেয়ে বৃথা অন্বেষণ ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ডিমেট্রিয়াস। পাককে প্রশ্ন করে ওবেরন বুঝতে পারলেন যে, পাক ভুল লোকের চোখে প্রেমরস ঢেলেছে। তাই নিজে গিয়ে যে যুবকটিকে তিনি খুঁজছিলেন, তার চোখে প্রেমরস ঢেলে দিলেন তিনি। ডিমেট্রিয়াসের ঘুম ভেঙে গেল। সে প্রথমেই দেখল হেলেনাকে। দেখামাত্র, লাইস্যান্ডারের মতো সেও হেলেনাকে উদ্দেশ্য করে প্রেমিক-সুলভ বক্তৃতা দিতে লেগে গেল। পিছন পিছন ছুটে এল হার্মিয়াও। পাকের দুঃখজনক ভুলের ফলে এখন তাকে তার প্রেমিকের পিছন ছুটে ছুটে বেড়াতে হচ্ছিল। এদিকে জাদুর বশে লাইস্যান্ডার আর ডিমেট্রিয়াস দু’জনেই হেলেনাকে উদ্দেশ্য করে প্রেম নিবেদন করছিল তখন।