জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর পরই প্রচণ্ড ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়েছিল রোমের শাসকদের ভিতর। যথারীতি সে লড়াই একদিন মিটেও গেল। এবার রোমের সিংহাসনে বসলেন জুলিয়াস সিজারের ভাগ্নে অক্টেভিয়াস বা অগাস্টাস সিজার। সিংহাসনে বসেই অগাস্টাস চাইলেন সমস্ত দেশে পাকাপাকিভাবে রোমান শাসন প্রচলন করতে। সে সময়ে ফ্রান্সের নাম ছিল গল। তখন রোম সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে সে দেশ শাসন করতেন রোমান সেনাপতি কেইয়াস লুসিয়াস। বহু বছর ধরে ব্রিটেন রাজকর না পাঠানোর জন্য সম্রাট অগাস্টাস তাঁর দূত হিসেবে ব্রিটেনে পাঠালেন কেইয়াস লুসিয়াসকে।
ব্রিটেনে এসে রাজা সিমবেলিনের সাথে দেখা করলেন সেনাপতি কেইয়াস লুসিয়াস। তিনি রাজাকে বললেন যেসব রাজকর পাওনা আছে তা পুরোপুরি মিটিয়ে দিতে। কিন্তু রাজা সিমবেলিন পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন ফ্রান্সকে কোনও রাজকর দেবে না ব্রিটেন।
তাহলে রাজা সিমবেলিন, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। আপনি–বলে গল-এ ফিরে গেলেন সেনাপতি কেইয়াস লুসিয়াস। কীভাবে ব্রিটেনকে আক্রমণ করা যায়। সে আয়োজনে ব্যস্ত রইলেন তিনি।
ব্রিটেনে পাসথুম্যাসের বাড়ি-ঘর বিষয়-সম্পত্তির দেখভাল করত তার বিশ্বস্ত ভৃত্য পিসানিও। একদিন প্রভুর কাছ থেকে মুখবন্ধ একটা খাম পেল সে। খাম খুলে দেখল তাতে দুটো চিঠি রয়েছে — একটি তার নামে আর অন্যটি আইমোজেনের নামে। নিজের নামে লেখা চিঠিটা পড়ল পিসানিও। তাতে লেখা আছে, আমার স্ত্রী যে অসতী ও কুলটা সে প্রমাণ আমি পেয়েছি পিসানিও। এই সাথে তার নামে একটা চিঠি দিলাম। তুমি সেটা অবশ্যই তাকে দিয়ে দেবে। ওই চিঠিতে লেখা আছে সে যেন গোপনে আমার সাথে দেখা করে ওয়েলসের জঙ্গলে।
এবার শোন কী করতে হবে তোমায়। তার নামে লেখা চিঠিটা আইমোজেনকে দিয়ে বলবে তার সাথে দেখা করার জন্য সবার অলক্ষে আমি লুকিয়ে রয়েছি ওয়েলসের জঙ্গলে। তবে আমি কিন্তু সত্যি সত্যি ওখানে যাব না। আমার সাথে দেখা করার অছিলায় তুমি আইমোজেনকে ওই জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করবে। আরা তার রক্তমাখা জামা-কাপড় পাঠিয়ে দেবে আমার কাছে। আমার এ আদেশের যেন ব্যতিক্রম না হয়।
আইমোজেনকে লেখা যে ছোটো চিঠিটা খামের মধ্যে ছিল তা খুলে পিসানিও দেখল তাতে লেখা রয়েছে, তোমার আদর্শনে আমি যে কী ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছি, তা ভাষায় বৰ্ণনা করা সম্ভব নয় প্রিয়ে। শুধু তোমাকে দেখার আশায় নির্বাসন দণ্ড উপেক্ষা করেও আমি সবার অগোচরে রোম থেকে পালিয়ে এসে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি মিলফোর্ডের কাছাকাছি ওয়েলসের জঙ্গলে। তুমি অবশ্যই পিসানিওকে সাথে নিয়ে আমার সাথে দেখা করবে।
চিঠি পড়ে তো বিস্ময়ে হতবাক পিসানিও। বলে কী? আইমোজেন অসতী, কুলটা? দিনরাত আইমোজেনের উপর নজর রাখছে পিসানিও। সে নিজের চোখেই দেখছে। যতই দিন যাচ্ছে পাসথুম্যাসের উপর আইমোজেনের ভালোবাসা ততই তীব্র হয়ে উঠেছে। তাহলে কীসের জন্য মনিব তার স্ত্রীকে অসতী, ব্যভিচারিণী বলে ভাবছেন! হয় মনিব তার স্ত্রীকে ভুল বুঝছেন, নতুবা কোনও ফেরোপবাজ লোক তাকে ভুল বুঝিয়েছে। — এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই পিসানিওর মনে।
মনিব যখন এমন একটা নিষ্ঠুর আদেশ দিয়েছেন তাকে, তখন আর চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। ঠান্ডা মাথায় এমন একটা উপায় বের করতে হবে যাতে দুই কূল বজায় থাকে। — মনিবের আদেশও পালন করা হয়। আর সেই সাথে আইমোজেনের প্রাণ বাঁচে। আহমোজেনকে লেখা মনিবের চিঠিটা সে তার হাতে তুলে দিল।
চিঠিটা পড়ে আইমোজেনের মুখে হাসি ফুটে উঠল। তার মন-প্ৰাণ খুশিতে ভরে উঠল। যখন সে জানল শুধু তারই সাথে দেখা করার জন্য গোপনে রোম থেকে পালিয়ে এসে ওয়েলসের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন তার স্বামী। স্বামীর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে সেদিন গভীর রাতে পিসানিওকে নিয়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে ওয়েলসের জঙ্গল অভিমুখে রওনা হলেন আইমেজেন। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটার পর তারা এসে পৌঁছালেন ওয়েলেসের জঙ্গলের সীমানায় মিলফোর্ডে। তখন আইমোজেন লক্ষ করে দেখলেন পিসানিওর হাবভাব যেন কেমন কেমন লাগছে। যে কোনও কারণেই হোক সে মাথা নিচু করে রয়েছে, কোনও কথা বলছে না। আইমোজেন এর কারণ জানতে চাইল পিসানিওর কাছে।
তখন পিসানিও তাকে পাসথুম্যাসের লেখা সেই চিঠিটা দেখাল যাতে তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাকে হত্যা করাই নয়, পাসথুমাস তাকে অসতী, কুলটা বলেছে। এ কথা জেনে থর থর করে কেঁপে উঠল আইমোজেনের সারা শরীর। সে অসতী, ব্যভিচারিণী? পিসানিওই তো দিনরাত দেখছে স্বামীর অবর্তমানে সে অন্য কোনও পুরুষের সাথে কথা বলেন না, নির্বাসিত স্বামীর কথা ভেবে সারারাত চোখের জল ফেলে, সেকিনা অসতী? আর সহ্য হল না আইমোজেনের। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, পসথুম্যাসের চোখে আমি যখন অসতী, ব্যভিচারিণী তখন আর বেঁচে থেকে লাভ কী? এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো; পিসানিও! তুমি আর দেরি না করে আমাকে হত্যা করে মনিবের আদেশ পালন কর।
পিসানিও বলল, মনিব বলেই যে আমি তার অন্যায় আদেশ মেনে নেব তা ভাববেন না আপনি। আমি নিঃসন্দেহ মনিব আপনাকে অন্যায় সন্দেহ করছেন। আমার মনে হচ্ছে কিছুদিন আগে আয়াকিমো নামে যে লোকটা এখানে ওর বন্ধু সেজে এসেছিল। সেই হয়তো রোমে ফিরে গিয়ে আপনার নামে আজে-বাজে কথা বলে মনিবের মন ভাঙিয়েছে। তাই হয়তো তিনি আপনার উপর মিথ্যে সন্দেহ করছেন। আপনি নিরাশ হবেন না। ঈশ্বরের উপর ভরসা রাখুন! যা প্রকৃত সত্য তা একদিন প্রকাশ পাবেই। ততদিন শাস্ত হয়ে অপেক্ষা করুন। আপনি। আমার মনে হয় আপনি পুরুষের ছদ্মবেশে রোমে যান, তাহলে স্বামীর অগোচরে ওর পাশে থেকে সবসময় ওর গতিবিধির উপর লক্ষ রাখতে পারবেন। তারপর সময় সুযোগ বুঝে ওর ভুল ধারণা ভেঙে দিয়ে পুনরায় তার সাথে মিলিত হতে পারবেন।