রাজা সিমবেলিন ছিলেন দুই পুত্রের জনক–একটির নাম গিভেরিয়াস আর অন্যটির নাম আরভিরেগাস। বড়ো গিভেরিয়াসের বয়স তখন তিন আর ছোটো আরভিগেরাসের এক। তাদের উভয়ের দেখাশোনার ভার ছিল ইউরিদাইল নামে এক সুন্দরী যুবতির ওপর।
এদিকে কিন্তু নিশচুপ হয়ে বসে রইলেন না বেলারিয়াস। সবার অলক্ষে তিনি গোপনে দেখা করলেন ইউদাইলের সাথে–অনেক প্রলোভন দেখিয়ে হাত করলেন তাকে। বেলারিয়াসের নির্দেশে সিমবেলিনের ছেলে দুটিকে রাজপ্ৰসাদ থেকে চুরি করে ইউরিদাইল তাদের নিয়ে এলেন ওয়েলসের জঙ্গলে বেলারিয়াসের গোপন আস্তানায়। এরপর বেলারিয়াস বিয়ে করলেন রাজবাড়ির ধাই ইউরিদাইলকে। নিজের ছেলের মতো তারা মানুষ করতে লাগলেন রাজার ছেলে দুটিকে–সেই পাহাড়-ঘেরা ওয়েলসের জঙ্গলে। তারা ছেলেদুটির নতুন নাম দিলেন পলিডোর আর কডওয়াল।
হারানো ছেলে দুটির অনেক খোঁজ-খবর করলেন রাজা সিমবেলিন। কিন্তু কোথাও তাদের সন্ধান পেলেন না। কিছুদিন বাদে রানি এক কন্যা সন্তানের জননী হলেন। রাজা তার মেয়ের নাম রাখলেন আইমেজেন। সে জন্মাবার কিছুদিন বাদেই মারা গেলেন তার মা।
তারপর এক এক করে অনেক বছর কেটে গেছে। ওয়েলসের জঙ্গলে পালিত সেই দুই রাজপুত্র আজ পূর্ণ যুবক। যে ধাইমা ইউরিদাইল তাদের নিজের ছেলের মতো মানুষ করে গেছেন তিনি বহুদিন আগেই গত হয়েছেন। বেলারিয়াস কিন্তু এখনও বেঁচে আছেন। জঙ্গলে আস্তানা বাঁধার পর থেকেই তিনি নিজের নতুন নাম নিয়েছেন মর্গান। সেই নামেই তিনি পরিচিত তার পালিত পুত্রদের কাছে। বাবার মতোই তারা তাকে মানে, ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। তিনিও তাদের নিজ সন্তানের মতোই ভালোবাসেন। তাদের আসল পরিচয় গোপন রেখে তিনি তাদের এমন শিক্ষা দিয়েছেন যাতে ভবিষ্যতে তারা আদর্শ রাজা হয়ে উঠতে পারে। এদিকে ততদিনে পূর্ণ যুবতি হয়ে উঠেছে রাজা সিমবেলিনের মেয়ে রাজকুমারী আইমেজেন। সে শুধু রূপসি আর গুণবতীই নয়, তার স্বভাবও খুব নম্র। তার আত্মমর্যাদাবোধ খুবই প্রবল। রাজার অবর্তমানে সেই যে সিংহাসনে বসবে তা জানে সবাই।
হঠাৎ এই বুড়ো বয়সে কী খেয়াল চাপল রাজা সিমবেলিনের মাথায়, তিনি বিয়ে করে বসলেন এক বিধবা মহিলাকে। সেই মহিলার আবার আগের পক্ষের এক ছেলে রয়েছে–নাম ক্লোটেন। বয়সে যুবক সেই ছেলে ক্লোটেন। শুধু বিবেকহীনই নয়, সে ভয়ংকর লোভী এবং চরিত্রহীন। হেন অপরাধ নেই। যা এই বয়সে সে করেনি। কোটেনের সাথে আইমোজেনের বিয়ে হলে ভবিষ্যতে সেই ব্রিটেনের সিংহাসনে বসবে, এই পরিকল্পনা মাথায় রেখেই সেই মহিলা রাজা সিমবেলিনের সাথে প্রেম-ভালোবাসার এমন অভিনয় করে যাতে তিনি বাধ্য হন মহিলাকে বিয়ে করতে।
বিয়ের পর নতুন রানি রাজপ্ৰসাদে এসে আইমোজেনকে নিজের বশে নিয়ে আসার জন্য মিষ্টি মধুর ব্যবহার করতে লাগলেন। অন্যদিকে আইমোজেনের নামে তিনি রাজার কাছে এমন সব মিথ্যে অভিযোগ জানাতে লাগলেন যাতে রাজা তার উপর চটে যান। আর সেই সাতে ভাবেন। যে তার মেয়েকে নতুন রানি নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করেন। রাজা যখন মেয়েকে বকা-ঝাকা করেন তখন রানি এমন মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলে আইমোজেনকে সাস্তুনা দেন যাতে তার উপর আইমোজেনের ভক্তি-শ্রদ্ধা বেড়ে যায়।
কিন্তু এতসব করা সত্ত্বেও রানির পরিকল্পনা সফল হবার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ক্লোটেন যে কত বড়ো শয়তান তা বুঝতে বাকি নেই আইমোজেনের। তাই শুধু ক্লোটেন নয়, নতুন রানিকেও এতটুকু বিশ্বাস করেন না আইমেজেন। মা ও ছেলে উভয়েই তার ঘৃণার পাত্র। রাজাকে এমন বশে এনেছেন নতুন রানি যে এখন তিনি চাইছেন আইমোজেনের সাথে বিয়ে হোক ক্লোটেনের। কিন্তু আইমোজেন তারা বাবাকে সরাসরি বলে দিয়েছে সে বরং সারাজীবন কুমারী থাকবে, তবুও তারা হাল ছাড়েননি। তারা ক্লোটেনকে বলে দিয়েছেন সে যেন সবসময় চেষ্টা করে কী ভাবে আইমোজেনকে খুশি করা যায়, তার মন জয় করা যায়।
ওদিকে রাজা, রানি আর ক্লোটেন কেউ কিন্তু তখনও পর্যন্ত জানতে পারেননি যে তার মনের মতো প্রেমিককে খুঁজে পেয়েছে আইমোজেন। সে প্রেমিকের নাম পাসথুমাস। একসময় তার বাবা বীর লিওনেটাস ছিলেন রাজা সিমবেলিনের সেনাপতি। এক যুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মারা যান লিওনেটাস। অনেক আগেই তার স্ত্রী একটি পুত্রসস্তানের জন্ম দিয়ে মারা যান। সেই অনাথ পুত্ৰ পসথুমাসকে লালন-পালনের জন্য নিজের কাছে নিয়ে আসেন রাজা সিমবেলিন, তার মেয়ে আইমোজেনের সাথে লেখা-পড়া শিখে সে বড়ো হয়ে উঠল। যৌবনে পা দিয়ে যুদ্ধবিদ্যাও শিখে নিল সে। ছোটোবেলা থেকেই তার ব্যক্তিত্ব, সততা, অধ্যবসায় দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল আইমোজেন। যৌবনে পা দিয়ে তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলল। তারপর সবার অগোচরে একদিন বিয়ে করে ফেলল। তারা। কিন্তু অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও আইমোজেনের বিয়ের খবরটা চাপা রইল না। রানির কাছে। সময়-সুযোগ বুঝে একদিন খবরটা রাজার কানে তুলে দিলেন তিনি।
আইমোজেন গোপনে পাসথুম্যাসকে বিয়ে করেছে শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন রাজা সিমবেলিন। পাসথুম্যাসকে রাজসভায় ডেকে এনে নির্বাসন দণ্ড দিলেন। তাকে আদেশ দিলেন এই মুহূর্তে ব্রিটেন ছেড়ে চলে যেতে হবে এবং ভবিষ্যতে আর কখনও ফেরা চলবে না –তাহলে প্ৰাণদণ্ড হবে।