যে বনে হার্মিয়া ও লাইস্যান্ডারের দেখা করার কথা ছিল, সেই বনটি ছিল ‘পরি’ নামে এক ধরনের ছোট্ট জীবের প্রিয় বিচরণক্ষেত্র।
পরিরাজ ওবেরন ও পরিরানি টাইটানিয়া তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে সেই বনে প্রমোদবিহারে আসতেন।
যে সময়ের কথা হচ্ছে, সেই সময় পরিদের এই ছোট্ট রাজা ও রানির মধ্যে এক দুঃখজনক কলহ উপস্থিত হয়েছিল। মনোরম বনের ছায়াঘেরা চন্দ্রালোকিত পথে বিহার না করে, তাঁরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করছিলেন। আর তাইতে ভয় পেয়ে তাঁদের অনুগত ভূতপ্রেতের দল হামা দিয়ে ওক-বিচির মধ্যে লুকিয়ে পড়েছিল।
মনান্তরের কারণ ছিল, টাইটানিয়ার চুরি করে আনা একটি ছোটো ছেলে। ছেলেটির মা ছিল টাইটানিয়ার সই। সে মারা যাওয়ার পর, টাইটানিয়া ছেলেটিকে তার ধাইয়ের কাছ থেকে চুরি করে এই বনে নিয়ে এসে মানুষ করছিলেন। আর ওবেরন ছেলেটিকে নিজের বালকভৃত্য নিয়োগ করতে চাইছিলেন।
প্রেমিকযুগলের যে রাতে বনে আসার কথা, সেই রাতেই টাইটানিয়া তাঁর রাজসখিদের নিয়ে ভ্রমণ করতে করতে ওবেরন ও তাঁর অনুচরদের মুখোমুখি হন।
“জ্যোৎস্নালোকে মূর্তিমতী অকল্যাণ তুমি, হে মদমত্তা টাইটানিয়া,” বললেন পরিরাজ। টাইটানিয়া উত্তরে বললেন, “কে? হিংসুটে ওবেরন নাকি? পরিরা, দূরে থেকো। ওঁর সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক ঘুচে গেছে জেনো।” “চোপরাও!” বললেন ওবেরন, “ভুলে যেও না, আমি তোমার স্বামী। এত সাহস তোমার, আমার মুখে মুখে কথা বলো! চুরি করে আনা ওই বাচ্চাটাকে দাও। আমি ওকে আমার বালকভৃত্য করে রাখব।”
“তোমার সে গুড়ে বালি,” টাইটানিয়া বললেন, “তোমার এই গোটা পরিরাজ্য আমাকে বেচে দিলেও আমি তোমার হাতে ছেলেটাকে ছাড়ব না।” এই বলে ক্রুদ্ধ রানি স্বামীর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন। ওবেরন বললেন, “যাও, যেখানে ইচ্ছে যাও। কিন্তু জেনে রেখো, কাল সূর্য ওঠার আগেই আমি এই অপমানের শোধ তুলব।”
ওবেরন ডেকে পাঠালেন তাঁর প্রিয় অনুচর তথা প্রধান পার্ষদ পাককে।
পাক ছিল এক দুষ্টু ভূত। কেউ কেউ তাকে ডাকত ‘ভালমানুষ ভূত’ নামে। আশেপাশের গ্রামবাসীদের অতিষ্ট করে সে মজা পেত। কখনও গব্যশালায় ঢুকে দুধের উপর ভেসে বেড়াত। হালকা বায়বীয় রূপ ধরে ডুব লাগাতো মাখন মন্থনের পাত্রে। গোয়ালিনী মাখন মন্থনের চেষ্টা করত। কিন্তু পাক সেখানে এমন নৃত্য জুড়ে দিত যে, তার সব চেষ্টাই বৃথা যেত। বাদ যেত না গ্রামের ধাতুশিল্পীরাও। পাকের দুষ্টুমিতে তামা নিষ্কাষণ তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে উঠত। পড়শিরা এক সঙ্গে মদ খেতে বসলে, পাক কাঁকড়া-কাবাবের আকার ধারণ করে ঝাঁপ দিত মদের গ্লাসে। কোনো ভালমানুষ বুড়ি চুমুক দিলেই, তার ঠোঁট ধরে ঝুলে পড়ত পাক। বুড়ির ঝুলে-পড়া চিবুক বেয়ে সব মদ গড়িয়ে পড়ে যেত। পরে বুড়ি পড়শিদের কাছে নিজের দুঃখের বৃত্তান্ত শোনাতে গেলে, পাক এক হ্যাঁচকায় বুড়ির বসার তেপায়াটা টেনে নিত। ধপাস করে বুড়ি পড়ত মাটিতে। সবাই হো হো করে হেসে উঠত। যেন এত মজার আর কিছুই কোনোদিন দেখেনি তারা।
ওবেরন তাঁর খোসমেজাজি নিশাচর ভৃত্যটিকে ডাক দিলেন, “পাক, এদিকে এসো। যে ফুলকে মেয়েরা ‘আলসেমির প্রেম’ নামে ডাকে, আমাকে সেই ফুল এনে দাও। সেই ছোট্ট লালচে ফুলটির রস কোনো ঘুমন্তের চোখে ঢেলে দিলে, ঘুম ভাঙার পর সে প্রথম যাকে দেখে, তারই প্রেমে পড়ে যায়। টাইটানিয়া যখন ঘুমাবে, তখন আমি তার চোখে সেই রস ঢেলে দেবো। ঘুম থেকে উঠে সে প্রথম যাকে দেখবে, সিংহ, ভালুক, বদমাস বাঁদর বা নোংরা বনমানুষ হলেও, তারই প্রেমে পড়ে যাবে সে। তখন তার থেকে বাচ্চাটাকে আদায় করব। তারপর বিপরীত জাদু প্রয়োগ করে তার আগের জাদু ফিরিয়ে নেব আমি।”
দুষ্টুমি পাকের খুব প্রিয় ছিল। প্রভুর দুষ্টুবুদ্ধির কথা শুনে সে তাই আহ্লাদে আটখানা হয়ে ছুটল ফুল আনতে। ওবেরন পাকের জন্য অপেক্ষা করছেন, এমন সময় দেখলেন ডিমেট্রিয়াস ও হেলেনা বনে ঢুকছে। চুপিচুপি তাদের কথা শুনতে লাগলেন তিনি। পিছু নেওয়ার জন্য ডিমেট্রিয়াস খুব কড়া ভাষায় হেলেনাকে তিরস্কার করছিল। মৃদু প্রতিবাদ করে হেলেনা তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে, একদিন হেলেনাকেই ডিমেট্রিয়াস তার সত্যিকারের প্রেমিকা বলে মেনে নিয়েছিল। ডিমেট্রিয়াস হেলেনাকে বন্য জন্তুর দয়ায় ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। হেলেনাও যত দ্রুত সম্ভব তার পিছু নিল।
পরিরাজ সত্যকারের প্রণয়ীদের খুব ভালবাসতেন। হেলেনার প্রতি তাঁর দয়া হল। লাইস্যান্ডার বলেছিল, তারা হেলেনাকে নিয়ে তাদের সুখের দিনে এই বনে বেড়াতে আসত। ডিমেট্রিয়াস তখন ভালবাসত হেলেনাকে। হয়ত সেই সময়েই পরিরাজ তাকে দেখে থাকবেন। সে যাই হোক, পাক ফুল নিয়ে এলে ওবেরন তাঁকে বললেন, “বনে একটি মিষ্টি এথেন্সীয় মেয়ে এসেছে। তার প্রেমিকটি অত্যন্ত অকৃতজ্ঞ। এই ফুলের একটা অংশ নিয়ে যাও। ছেলেটিকে দেখতে পেলে, তার চোখেও এই প্রেমসুধারস একটু ঢেলে দিও। এমন সময় কোরো যখন মেয়েটি তার কাছাকাছি থাকবে। আর খেয়াল রেখো যাতে ঘুম থেকে উঠে মেয়েটিকেই আগে দেখতে পায় সে। দেখবে, ছেলেটা এথেন্সীয় পোষাক পরে আছে। তাই দেখেই চিনতে পারবে।” হাত-পা নেড়ে পাক জানিয়ে দিল, সে সব সামলে নেবে। তারপর ওবেরন চুপিচুপি গেল টাইটানিয়ার নিকুঞ্জে। টাইটানিয়া সেখানে বিশ্রাম নেওয়ার তোড়জোড় করছিলেন। উডবাইন, মাস্ক-রোজ আর ইগলেন্টাইনের চাঁদোয়ার নিচে বুনো টাইম লতা, কাউস্লিপ ফুল ও মিষ্টি ভায়োলেট ফুলের ঝোড়ের মাঝখানে ছিল টাইটানিয়ার নিকুঞ্জশয্যা। রাতের কিছুটা সময় সেখানে সাপের খোলস ঢাকা দিয়ে ঘুমাত টাইটানিয়া। খোলসটা ছোটো হলেও, টাইটানিয়ার তাতেই বেশ চলে যেত।