মদ্দাটার আক্রমণে পানির তলায় কাঠের পাটাতন দারুন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে; চামড়ার বালতি দিয়ে সেঁচেও জাহাজে পানি উঠা ঠেকানো যাচ্ছে না। দাঁড়টানা যোদ্ধাদের নিজ নিজ কাজ ফেলে এটা করতে হচ্ছে বলে সময়ও নষ্ট হচ্ছে প্রচুর। নিশ্চই এর থেকে মুক্তির কোনো না কোনো উপায় আছে, নিজের মনেই ভাবলাম আমি।
নিহত জন্তুগুলোর দেহ ভেসে উঠার অপেক্ষায় আছি আমরা, একটা দার্স মেয়েকে ডেকে পাঠালাম আমার লেখার সরঞ্জাম ভর্তি পাত্র নিয়ে আসার জন্যে। এরপরে, মনে মনে ভেবে রাখা একটা প্রক্রিয়া এঁকে নিতে লাগলাম; যুদ্ধ-গ্যালির পাটাতনে উঠা পানি কৌশলে সরিয়ে নেওয়ার একটা উপায়, যাতে করে অর্ধেক যোদ্ধার প্রয়োজন হবে না এ কাজে। বারো জনের বদলে মাত্র দুইজনকে দিয়ে কাজটা করা সম্ভব বলেই আমার ধারণা।
আঁকা শেষ হতে গ্যালির অবস্থা পর্যবেক্ষণে গেলাম আমি। ইতিহাস বলে, ভূমির যুদ্ধের মতোই জলপথেও গ্যালি নিয়ে যুদ্ধের কৌশলগত পার্থক্য সামান্যই। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর চালনা। এরপরে, কাছাকাছি এসে অন্য জাহাজের দখল নিয়ে তলোয়ারের মাধ্যমেই ফয়সালা করা হয়। পরস্পর সংঘর্ষ থেকে দারুনভাবে সতর্ক থাকতে হয় গ্যালির প্রধান নাবিককে; মুখোমুখি ধাক্কা খাওয়া অত্যন্ত লজ্জাজনক বলে মনে করা হয়।
কিন্তু যদি–হঠাৎই একটা ভাবনা উঁকি দিলো আমার মনে; ভিন্ন রকম ভাবে সজ্জিত নতুন এক ধরনের গলুইয়ের ছবি আঁকলাম প্যাপিরাস ফ্রোলে। পরিকল্পনা ডালাপালা ছড়াতে লাগলো পানির সমান্তরালে গন্ডারের শিং-এর মতো একটা স্থাপনা যোগ করে দিলাম আমি। চেলাকাঠ থেকে তৈরি, ব্রোঞ্জের মাথাওয়ালা। সামনের দিকে বাঁকানো; এতে করে সামনের কোনো জল্যানের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটলে ওটাকে ছিঁড়ে ফেঁড়ে ফেলা যাবে। এতটাই তন্ময় হয়ে ছিলাম, কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ট্যানাস, টের পাইনি। আমার হাত থেকে প্যাপিরাসের স্ক্রোলটা ছিনিয়ে নিল সে; মনোযোগ দিয়ে দেখছে।
আমি কি ভাবছি, এটা অবশ্য সাথে সাথেই বুঝেছে সে। ওর বাবা সর্বস্ব হারিয়ে যখন পথের ভিখারী, বহু সাধ্য-সাধনা করে একজন ধনী লোকের সাহায্যে ওকে কোনো একটি মন্দিরে অন্তত: শিক্ষানবিস লিপিকারের কাজে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলাম; এতে করে কাজের পাশপাশি পড়া-শোনাটাও চালিয়ে নিতে পারতো সে। নিজের ছাত্র সম্পর্কে আমার ধারণা খুবই উঁচু, আমি মনে করি, সাঁকোয়ারাহ্–এ নির্মিত প্রথম পিরামিডের কারিগর ইমহোটেপের মতোই মিশরের ইতিহাসের অন্যতম সেরা বুদ্ধিজীবি হওয়ার সামর্থ্য তার আছে। এক হাজার বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছিলো ওটা।
কিন্তু, স্বাভাবিকভাবেই সেটা সম্ভব হয় নি। ট্যানাসের বাবার বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো, তাদেরই অনেকে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ওর পথে। দেশের একজন ব্যক্তি, তাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিলো না। বাধ্য হয়ে ওকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বলেছিলাম। দুঃখের বিষয়, যেদিন থেকে প্রথম দাঁড়াতে শিখেছিল, যোদ্ধা হওয়া ছিলো তার ধ্যান-জ্ঞান।
সেথ্–এর পাছার বিষফোঁড়ার নামে কসম! বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলো ট্যানাস, আমার আঁকাগুলো দেখতে দেখতে। তুমি আর ওই লেখনী দশ বাহিনীর সমান আমার কাছে!
পরাক্রমশালী দেবতা সেথকে নিয়ে ট্যানাসের এই ধরনের উপহাস বরাবরই ভাবিয়ে তোলে আমাকে। আমি বা সে, যদিও আমরা দুজনেই দেবতা হোরাসের উপাসক, এরপরেও মিশরের ঐতিহাসিক দেবদেবীর কাউকে নিয়ে ঠাট্টা করা সমীচীন নয়। যেকোনো মন্দিরে গেলেই কোনো না কোনো প্রার্থনা বা কোরবানী দেওয়া আমার স্বভাব, তা সে যে দেবতারই হোক না কেন। আমার মতে, ওটা হলো নিরাপত্তার কবচ। মানবসমাজেই যথেষ্ট শত্রু আছে আমাদের, অযথা দেবতা পর্যায়ে সেরকম কিছু তৈরি করা অবিবেচকের পরিচয়। বিশেষতঃ দেবতা সেথ-এর আক্রোশ নিয়ে বহু উপকথা প্রচলিত আছে। আমি অবশ্যই ভয় পাই তাঁকে। হয়তো ট্যানাসের এটা জানা আছে বলেই আমাকে বিরক্ত করার জন্যে বারবার উপহাস করে। যাই হোক, প্রশংসার জলে ভিজে আমার রাগ দূর হয়ে গেলো।
কেমন করে করো এগুলো? জানতে চায় ট্যানাস। আমি হলাম যোদ্ধা। আজ যা যা ঘটেছে, তোমার মতো আমিও দেখেছি। কিন্তু এই ভাবনাগুলো আমার মাথায় কেন এলো না?
আমার আঁকা ছবিগুলো নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হলাম দুজন। কিছুসময়ের মধ্যেই লসট্রিসও যোগ দিলো সাথে। দাসী মেয়েগুলো ওর চুল মুছে বেঁধে দিয়েছে, মুখেও প্রসাধনী ব্যবহার করেছে খানিকটা। মনোযোগ বজায় রাখাটা মুশকিল হয়ে পড়ল, বিশেষত যখন একটা হাত আনমনে আমার কাঁধে ফেলে রেখেছে সে। জনারণ্যে কোনো পুরুষ মানুষের দেহে এভাবে হাত রাখবে না লসট্রিস, ভদ্র-আভিজাত্যে সেটা সাজে না। কিন্তু আমি তো আর পুরুষ মানুষ নই; আর সারাটা সময় ট্যানাসের মুখেই সেঁটে থাকলো ওর চোখ দুটো।
ট্যানাসের প্রতি ওর এই মোহ সেই যখন ও বুঝতে শিখেছে, তখন থেকে। দশ বছরের বালক ট্যানাসের পেছন পেছন টলোমলো পায়ে হাঁটতে লসট্রস, সবসময় নকল করত তার ভাবভঙ্গি। ট্যানাস থুতু ফেলেছে, তো তারও ফেলতে হবে। ট্যানাস যদি কোনো বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলো; তো তারও করা চাই। শেষমেষ বিরক্ত হয়ে বালক আমার কাছে বিচার নিয়ে আসতো, ওকে আমার পিছ-ছাড়া করতে পারো না, টাইটা? একটা পুঁচকি। মজার ব্যাপার, আজ আর তেমন কোনো অভিযোগ ট্যানাস করছে না।