এক লাফে গলুইয়ে চড়ল সে; নিজেকে স্থির করে নিয়ে তাকাল নিচের পানিতে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর জন্তুটার দিকে। এরপরে, দুই হাতে তলোয়ার নিচু করে ধরা অবস্থায় বাজ পাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো শূন্যে।
মদ্দাটার বিশাল ঘাড়ের উপর খাড়া হয়ে নামলো ট্যানাস, যেনো বিশাল প্রাণীটাকে পানিতে ডুবিয়ে দেবে। নিজের শরীরের ওজন, এতো উঁচু থেকে লাফের শক্তি–সবই ছিলো তলোয়ারের পেছনে। ঘাড়-মাথার সংযোগস্থলে পুরো অর্ধেক ফলা সেঁধিয়ে গেলো; উপরে চড়ে বসা ট্যানাস তার শক্তিশালী দুই কাঁধের জোরে খুঁচিয়ে আরো ভেতরে নিয়ে যেতে লাগলো সেটা। ল্যাগুনের জল ছেড়ে প্রায় পুরোটা শরীর শূন্যে নিক্ষিপ্ত হলো প্রাণীটার; এপাশ-ওপাশ দুলছে মাথা, পানির ভারী পশলা এত উপরে ছিটকে আসছে যে, আমাদের গ্যালিতে পর্দার মতো আড়াল তৈরি করে ফেললো নিচের রোমাঞ্চকর দৃশ্য থেকে।
এত কিছুর ভেতর দিয়েও, জন্তুটার পিঠে অসহায়ভাবে এক জোড়া মানুষকে দুলতে দেখছি আমি। হাতের একটা তীরের মাথা ছুটে যেতে প্রায় পরে যেতে বসেছে লসট্রিস। তেমনটি ঘটলে, তীক্ষ্ণ দাঁতে ওকে ফালাফালা করে ফেলবে মরণাপন্ন জলহস্তি। পেছনে ঝুঁকে এক হাতে লসট্রিসের পতন ঠেকালো ট্যানাস; ডান হাতে অবিরত খুঁচিয়ে চললো তলোয়ারের ফলাটা জানোয়ারটার শরীরের গভীরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে আরো।
ওদের নাগাল না পেয়ে দাঁত খিচাল জটা; গলার দুধারে মারাত্মক ক্ষত দেখা দিয়েছে ওটার গ্যালির পঞ্চাশ গজমত দূরের প্রতিটি প্রাণী, লসট্রিস এবং ট্যানাসের পা থেকে মাথা পর্যন্ত রক্তের ধারায় ভিজে গেলো । লাল পর্দার আড়াল থেকে কেবল চকচকে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে চোখদুটো।
মদ্দাটার মরণ-আস্ফালন গ্যালির পাশ থেকে বেশ খানিকটা দূরে ঠেলে নিয়ে গেছে ওদের; একমাত্র আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম সবার আগে। দাড়ীদের উদ্দেশ্যে চেঁচালাম, অনুসরণ কর ওটাকে! যেনো পালিয়ে যেতে না পারে! চমকে উঠে কাজে লেগে পরে তারা, সচল হয় হোরাসের প্রশ্বাস।
ঠিক সেই সময়েই, ট্যানাসের ব্রোঞ্জের ফলা সম্ভবত জন্তুটার ঘাড়ে মেরুদণ্ডের, সংযোগস্থল খুঁজে পায়, সেঁধিয়ে পরে ছিঁড়ে ফেলে মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগ। বিশাল শরীরটা যেনো জমে গেলো জায়গায়। শক্ত করা চার পা লম্বা করে চিৎ হয়ে পড়লো ওটা, ল্যাগুনের পানিতে লসট্রিস আর ট্যানাস সমেত তলিয়ে গেলো।
গলা দিয়ে উঠে আসা হতাশার চিৎকারটা রোধ করলাম আমি; হুঙ্কার দিয়ে নির্দেশ দিতে লাগলাম নৌকার পাটাতনে দাঁড়ানো হতবুদ্ধ কর্মীদের। পেছনে টানো! ওদের উপরে চড়ে বসো না! গলুইয়ের সাঁতারুরা ঝাঁপিয়ে পর! নিজের কণ্ঠস্বরের শক্তিমত্তা এবং দায়িত্বে এমনকি আমি নিজেও চমকে গেছি।
গ্যালির সম্মুখ-যাত্ৰা রোধ হলো। কী করছি বুঝে উঠার আগেই পাটাতনের উপর দিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় যোদ্ধার দলের মাঝখান দিয়ে ছুটলাম। অন্য কাউকে নৌকা থেকে পরে যেতে দেখলে হয়তো আমোদ পেত এরা, কিন্তু তাদের বীর সেনাপতি ট্যানাসকে দেখে নয়।
আমি স্কার্ট খুলে ফেলেছি ইতোমধ্যেই সম্পূর্ণ নগ্ন এই মুহূর্তে। ভিন্ন কোনো সময়ে চাবুকের একশ ঘা দিয়েও এটা করানো যেত না আমাকে দিয়ে, সাম্রাজ্যের জল্লাদের অনেক কাল আগে করা কীর্তি মাত্র আর একজন মানুষকে দেখেছে; মূলত সেই ব্যক্তিই খোঁজা করার উদ্দেশ্যে ছুরি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন আমার উপর। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, পৌরুষের তেজদীপ্ত অঙ্গহারা নিজেকে অন্যদের দৃষ্টির সামনে প্রদর্শন করতে এতটুকু ভাবলাম না।
খুব ভালো সাঁতারু আমি, হয়তো অন্য কোনো সময়ে এ ধরনের আচরণকে বোকামীর চোখে দেখতাম; কিন্তু আমি সত্যিই বিশ্বাস করি রেইল টপকে রক্তাক্ত পানিতে ঝাঁপিয়ে পরে সম্ভবত আমার মিসট্রেসকে উদ্ধার করতে পারবো এ যাত্রায় । যাই হোক, জাহাজের রেইলে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম; ঠিক আমার নিচের পানি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো দুটো মাথা এত কাছাকাছি যেনো পরস্পর মিলিত হয়ে আছে। একটা মাথা কালো, অপরটি পরিষ্কার, কিন্তু ও দুটোই আমার কাছে সবচেয়ে অভাবিত আচরণ করছিল। হাসছিলো ওরা। উত্তেজনা, আনন্দ আর রোমাঞ্চে হাসছে লসট্রিস আর ট্যানাস; জাহাজের পাশ ঘেঁসে ভেসে থেকে পরস্পরকে এতটা জোরে আঁকড়ে ধরে আছে, সন্দেহ হলো ডুবে না যায়।
সাথে সাথেই আমার যত উদ্বেগ পর্যবসিত হলো রাগে–এই উন্মাদনার প্রতি। নিজের প্রায় করতে যাওয়া নির্বুদ্ধিতার জন্যেও রাগ হচ্ছিলো খুব। হারানো সন্তানকে ফিরে পাওয়া মায়ের মতোই তীরস্কারে ব্যাপৃত হলাম; নিজের কণ্ঠস্বরে আর আগের দায়িত্ব নেই, আছে স্বস্তি মিশ্রিত উপহাস। ডজনখানেক উদ্বেল হাত যখন পানি থেকে ওদের দুজনকে টেনে তুললো জাহাজে, তখনও আমার মিসট্রেসকে তীরস্কার করছিলাম আমি।
তুমি অসাবধানী, পরিচর্যা না করা জংলী! ওর উদ্দেশ্যে ক্ষোভের স্বরে বলছিলাম, নির্বোধ! স্বার্থপর, অবাধ্য কোথাকার! প্রতিজ্ঞা করেছিলে আমার কাছে! দেবীদের কুমারীত্বের নামে কসম কেটেছিলে
দৌড়ে এসে আমাকে গলার দুধারে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো লসট্রিস। ওহ টাইটা! বলে উঠল, এখনও হাসছে আনন্দে। তুমি দেখেছ ওকে? দেখেছ, কেমন করে আমাকে উদ্ধার করেছে ট্যানাস? তোমার শোনা সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ কাজ ছিলো না ওটা? তোমার গল্পগুলোর সেই নায়কদের মত?