আবার ভেসে উঠলো মদ্দাটা; কিন্তু এবারে আমাদের গ্যালির মুখোমুখি । এতো বড় হা করা মুখ, গলার ভেতরে অনেকদূর দেখতে পেলাম। যেনো লাল মাংসের একটা সুড়ঙ্গ, সহজেই আস্ত একটা মানুষ গিলে খেতে পারবে। চোয়ালের তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো দেখে গা শির শির করে উঠলো আমার। নিচের চোয়ালে কাস্তে আকৃতির দাঁতগুলো প্রয়োজন হয় প্যাপিরাসের শক্ত নল ছিঁড়ে চিবুতে। উপরের চোয়ালে ঠিক আমার কবজির সমান চওড়া সাদা দাঁত; হোরাসের প্রশ্বাসে এর হাল-পাটাতন এমন সহজ ভাবে কেটে ফেলতে পারবে, যেমন করে পিঠা খাই আমরা। সম্প্রতি নদীর ধারে প্যাপিরাসের ঝোঁপ কাটার সময় এক জলহস্তিকে ভড়কে দেওয়া হতভাগ্য কৃষাণীর দেহাবশেষ দেখেছি; মাত্রই বাচ্চার জন্ম দিয়েছিল মাদী জটা; এমনভাবে দুই ভাগ হয়ে গেছিল মেয়েটার শরীর, যেনো ব্রোঞ্জের ফলা দিয়ে কাটা হয়েছে।
আর এখন, এই ক্ষ্যাপা জটা চকচকে দাঁত বের করে বিশাল হা সমেত চড়ে বসতে চাইছে আমাদের উপর; স্টার্ন টাওয়ারের সবচেয়ে নিরাপদ অবস্থানে থেকেও ভয়ে, আতঙ্কে ঠিক দেবতাদের মূর্তিগুলোর মতোই স্থির, বাকরুদ্ধ হয়ে রইলাম আমি।
আরো একটা তীর ছুঁড়লো ট্যানাস; সোজা মদ্দাটার হাঁ করা মুখের ভেতরে ঢুকে গেলো সেটা। কিন্তু ইতোমধ্যেই এতটা যন্ত্রণা সয়েছে ওটা, নতুন করে কিছু অনুভব করছে না। যদিও এবারের আঘাতটা নিঃসন্দেহে প্রাণঘাতি। কোনো রকম অস্বস্তি ছাড়াই হোরাসের প্রশ্বাসের গলুইয়ে চড়ে বসল ওটা। আঘাতপ্রাপ্ত গলার গভীরে কোথাও একটা ধমনী ছিঁড়ে গেছে; মরণ-চিৎকারে খোলা চোয়ালের ফাঁক দিয়ে গরম রক্তের ধারা যেনো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়লো। ঝকঝকে সূর্যালোকে লাল একটা মেঘের মতো জেগে রইলো বাতাসে; একইসঙ্গে কী মোহনীয় আর আতঙ্ক-জাগানিয়া। আর এরপরেই, সোজা আমাদের গলুইয়ের উপর আছড়ে পড়লো জটা।
দ্রুত ধাবমান গ্যাজেল হরিণের গতিতে ছুটছিল আমাদের গ্যালি; কিন্তু রাগে উন্মাদ, মৃত্যু-যন্ত্রণায় কাতর মদ্দাটার বিশাল আকারের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটলো হোরাসের প্রশ্বাসের। দাঁড়-টানা বেঞ্চের থেকে এদিক-সেদিক নিক্ষিপ্ত হলো যোদ্ধারা; স্টার্ন টাওয়ারের মাথা থেকে রেইলিংয়ের উপর এতো জোরে আছড়ে পড়লাম আমি, বুকের ভেতরের সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেলো এক পলকে নিঠুর যন্ত্রণা এখন সেখানে।
কিন্তু, এমনকি নিজের এই অবস্থাতেও আমার মূল দুঃশ্চিন্তা আমার মালকীনের জন্যে। চোখের পানিতে ঝাপসা দৃষ্টি; এরমধ্যেই দেখলাম সংঘর্ষের প্রাবল্যে ছিটকে সামনে পরে গেছে সে! হাত বাড়িয়ে ওকে ধরতে যথেষ্টই চেষ্টা চালাল ট্যানাস, কিন্তু সে নিজেও সংঘর্ষের কারণে টালমাটাল; বা হাতে ধরা ধনুকটাও বাধা হয়ে দাঁড়াল তার প্রচেষ্টায় । লসট্রিসের অধঃগতি কেবল কিছু সময়ের জন্যে রোধ করতে সক্ষম হলো সে; এরপরে হাত-পা ছড়িয়ে রেইলের উপর পড়লো লসট্রিস, পিঠ বাঁকা করে টপকে গেলো ওটা।
ট্যানাস, আতঙ্কে চেঁচালো মেয়েটা, এক হাত বাড়িয়ে ট্যানাসের হাত ধরতে চাইছে। মুহূর্তের মধ্যে দড়াবাজের কৌশলে ভারসাম্য ফিরে পেলো ট্যানাস, ধরতে চাইল হাতটা। এক পলকের জন্যে ওদের আঙ্গুল চুল পরস্পরকে, তারপর যেনো টেনে সরিয়ে নেওয়া হলো লসট্রিসকে।
সবার উপরে, স্টার্ন টাওয়ারে দাঁড়িয়ে লসট্রিসের পতন দেখতে পেলাম আমি। ঠিক বিড়ালের মতো শূন্যে মোচড় খেল সে, সাদা স্কার্ট কোমরের উপরে উঠতে দৃশ্যমান হলো এক জোড়া অসাধারণ উরু। মনে হলো যেনো এক জনম ধরেই পড়ছে সে, আমার হতাশ চিৎকারের সাথে মিশে গেছে ওর দারুন আর্তনাদ।
আমার ছোট্ট সোনা! কেঁদে ফেললাম আমি, আমার মিসট্রেস! নিশ্চিত জানি, ওকে হারিয়েছি আমরা। ওর পুরো জীবনটা যেনো এক লহমায় ভেসে উঠলো চোখের সামনে। বাচ্চা বয়সে ওর কান্না, দুষ্টামি; আমার সাথে যত খুনসুটি সব মনে পরে গেলো একে একে। তরুণী হয়ে উঠতে দেখেছি আমি ওকে; ওর প্রতিটি আনন্দে, যন্ত্রণায় আমার চেয়ে কাছাকাছি আর কে ছিলো? গত চৌদ্দটি বছরে ওকে যতোটা ভালোবেসেছি; আজ ওকে হারাবার দিনে যেনো তার চেয়ে বেশি ভালোবাসি মনে হলো।
বিশাল, রক্ত-চর্চিত মরণাপন্ন মদ্দাটার পিঠে আছড়ে পড়লো লসট্রিস; এক মুহূর্তের জন্যে হাত-পা ছড়িয়ে পরে থাকলে সেখানে; যেনো কোনো ধর্মের বলি হিসেবে ফেলে রাখা হয়েছে মূর্তির সামনের বেদীতে। পাক খেয়ে শূন্যে ভেসে উঠলো জলহস্তি, বিশাল, আক্রান্ত ঘাড় ঘুরিয়ে নাগাল পেতে চাইছে তার। রক্তাক্ত, শূকরের মতো ছোটো ছোটো চোখ দুটো রাগের সাথে পাল্লা দিয়ে জ্বলল, চোয়াল হাঁ হয়ে আছে।
কেমন করে যেনো নিজেকে ধরে রেখেছে লসট্রিস; জটার বিশাল পেছন থেকে বের হওয়া তীরের মাথা ধরে আটকে রেখেছে শরীরটা। হাত-পা ছড়িয়ে পরে আছে সে। এখন আর আর্তনাদ করছে না, বেঁচে থাকার জন্যে ব্যস্ত সময় কাটছে প্রতিটি প্রচেষ্টায়। প্রতিবার মনে হলো, যেনো এক চুলের জন্যে তার নাগাল পেলো না জলহস্তির হাঁ করা মুখ।
নৌকার সামনে, নিজেকে দ্রুত ফিরে পেলো ট্যানাস। এক মুহূর্তের জন্যে ওর মুখটা দেখতে পেলাম আমি, রাগে উন্মত্ত। একপাশে এই মুহূর্তে অকার্যকর ধনুকটা সরিয়ে রাখলো সে; পরিবর্তে আঁকড়ে ধরলো তলোয়ারের বাঁট। কুমীরের চামড়া দিয়ে তৈরি খাপ থেকে মুক্ত হলো ফলা, প্রায় তার হাতের সমান লম্বা সেটা; তামার তৈরি চকচকে।