পেছনে লেগে থাকো! হুঙ্কার ছাড়ল ট্যানাস।
ওই তো, চিৎকার করে উঠে হাতের ইশারায় পাশে দেখালাম আমি, ফিরে আসছে ওটা!
দারুন দেখালে, বুড়োখোকা, আমার উদ্দেশ্যে হাসলো ট্যানাস, তোমাকে ঠিক ঠিক যোদ্ধা বানাতে পারবো আমরা, এখনও সময় আছে। একেবারেই বাজে কথা এটা, আমি একজন লিপিকার, গীতি-নাট্যকার বা শিল্পী হতে পারি যোদ্ধা কখনও নই। আমার যুদ্ধ চলে মনের গভীরে। এরপরেও ট্যানাসের প্রংশসায় সবসময়ের মতোই আপ্লুত হলাম। নৌকার উপরের উত্তেজনার বুঝি কোনো সীমা-পরিসীমা নেই এই মুহূর্তে।
দক্ষিণে, আমাদের বাহিনীর অন্যান্য গ্যালিগুলো যোগ দিলো শিকারে। হ্রদের পানির জলহস্তির সংখ্যা সতর্কভাবে হিসেব করে রাখে হাপির মন্দিরের পুরোহিতেরা। দেবতা ওসিরিসের উৎসবের জন্যে পঞ্চাশটি পর্যন্ত শিকার করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে আমাদের। এরপরেও, প্রায় তিনশ প্রাণী থাকবে হাপির ল্যাগুনে; ফলে আগাছা এবং প্যাপিরাসের ঝোঁপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে বলে মনে করেন মন্দিরের পুরোহিতেরা । দেবতা ওসিরিসের উৎসবের দশ দিন বাদে একমাত্র পুরোহিতেরা ছাড়া আর কেউ জলহস্তির মাংস খেতে পারে না।
পানির উপরে জটিল নৃত্যের মতো ছড়িয়ে পরে শিকার অভিযান। ঢেউয়ের তালে নাচতে লাগলো আমাদের গ্যালিগুলো; ধাওয়া করে চললো বিশাল জন্তুগুলোকে। পানিতে ডুবে আবার ভেসে উঠছে ওগুলো, শিষের মতো আওয়াজ করে পানি ছিটাচ্ছে; জান্তব হুঙ্কারে প্রকম্পিত হলো এলাকা। বারবার ডুবে আবার ভেসে উঠছে, প্রতিবার কমে আসছে পানির নিচে স্থায়িত্বকাল। ফুসফুস খালি হয়ে গেছে জল্পগুলোর, কিন্তু শ্বাস নিতে যখনই উপরে ওঠছে, আমাদের ধাওয়ারত গ্যালিগুলো চড়ে বসছে মাথার উপর বাধ্য করছে আবারো ডুব দিতে। প্রতিটি গ্যালির স্টার্ন টাওয়ারের গং বাজছে প্রচণ্ড শব্দে; দাঁড়া টানা যোদ্ধাদের অমানুষিক চিৎকারের সাথে তাল মিলিয়ে। আদিম, পাশবিক কোনো দৃশ্যের মঞ্চায়ন–এমনকি সবচেয়ে রক্তপিপাসু কোনো বর্বরের মতো উত্তেজনায়, আনন্দে আমিও চিৎকার করছি–আবিষ্কার করলাম।
প্রথমে যেটাকে দেখেছিলাম, সেই বিশালতম মদ্দাটার পেছনে লেগে আছে ট্যানাস। তীরের নাগালের মধ্যে থাকা মাদী-জন্তু আর বাচ্চাগুলোকে উপেক্ষা করছে সে। এঁকেবেঁকে, পেঁচিয়ে ডুবে, ভেসে আবার ডুবে ফাঁকি দেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করে চললো জটা কিন্তু প্রতিবারে আরো কাছে চলে এলো আমাদের গ্যালি। এতো উত্তেজনার মাঝেও হোরাসের প্রশ্বাস পরিচালনায় ট্যানাসের মুন্সিয়ানার প্রশংসা না করে পারলাম না; অদ্ভুত পারদর্শিতার সাথে নির্দেশনা দিয়ে চলেছে সে প্রতিটা মুহূর্ত। দাঁড়ীরাও তার আদেশ পালন করছে সুনিপুণভাবে। বোঝাই যায়, জন্ম-ভাগ্য বা পদস্থ বন্ধু-বান্ধব না থাকার পরেও কেমন করে এত কম বয়সে ফারাওয়ের বাহিনীতে আজকের উচ্চতায় পৌঁছেছে সে। সবই নিজের প্রচেষ্টায়, পরিশ্রমে–কোনোসময়ই তার পথে কাঁটা বিছানোর লোকের অভাব ছিলো না।
হঠাৎই আমাদের গলুই থেকে মাত্র তিরিশ গজ দূরে ভেসে উঠলো মদ্দাটা। সূর্যরশ্মি ঝিকমিক করছে তার চকচকে পিচ্ছিল শরীরে পরে; কালো আর বিপুল; নাকের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসছে বাষ্পের মেঘ ঠিক যেনো অন্ধকার জগতের শয়তানের মতো।
চোখ ধাঁধানো দ্রুততার সাথে ধনুকে তীর জুড়েই ছুঁড়ে দিলো ট্যানাস। কঁপা, কাঁপা- মৃদু আওয়াজের সাথে ছুটল সেটা লানাটা থেকে, চোখে ঠাওর হয় না, এতো দ্রুত। প্রথম তীরটা বাতাসে ভাসমান অবস্থাতেই ছুটল দ্বিতীয়টা; এরপরে আরো একটা। ধনুকের ছিলো যেনো কোনো বাদ্য-যন্ত্র, বাঁশির মতো শব্দ করে চলেছে ঘন ঘন। পর পর আঘাত করলো তীরগুলো জন্তুটার বিশাল পেছনটায়, পুরোটা সেঁধিয়ে গেছে; আর্তনাদ করে উঠে আবার ডুব দিলো মদ্দাটা।
বিশেষত আজকের অভিযানের জন্যে ভিন্ন তীর প্রস্তুত করেছিলাম আমি। পালকের পাতাগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে সেগুলো থেকে, তার বদলে জেলেরা তাদের জালে যে বেওয়াব গাছের কাঠের ছোটো টুকরো ব্যবহার করে, সেরকম লাগানো হয়েছিলো। তীরের মাথা থেকে এমনভাবে বেরিয়ে থাকে ওগুলো, গতিপথে কোনো পরিবর্তন আসবে না; কিন্তু একবার সেঁধিয়ে গেলে ছড়িয়ে পড়বে জন্তুটার শরীরে। ব্রোঞ্জের মাথার সাথে লিনেনের সুতা দিয়ে বাঁধা জন্তুটা পানিতে তলিয়ে যেতেই কাঠের টুকরোগুলো ভেসে উঠে আমাদের জানিয়ে দিলো ওটার অবস্থান। উজ্জ্বল হলুদ রঙে ওগুলোকে রাঙিয়েছিলাম আমি, এতে করে পানির উপরে স্পষ্টই দৃশ্যমান হয়েছে। মদ্দাটার অবস্থান প্রতিনিয়ত জানতে পারছি আমরা, যদিও ল্যাগুনের গভীর পানির তলায় রয়েছে ওটা।
জলহস্তির শেষ আক্রমনের সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করা এখন সহজ হয়ে গেছে ট্যানাসের জন্যে। প্রতিবার যখনই ভেসে উঠলো জটা, আগে থেকেই অবস্থান নিয়ে তার চকচকে পিঠে তীর গেঁথে দিতে লাগলো সে। হোরাসের প্রশ্বাস ও সেইমতো পিছু ধাওয়া করে চললো। এতক্ষণে লাল হতে শুরু করেছে ল্যাগুনের পানি। ট্যানাসের ছোঁড়া তীর আঘাত করেছে জায়গামত। এত উত্তেজনার মধ্যেও প্রতিবার উপরে ভেসে ওঠা জন্তুটার জন্যে মায়া অনুভব করলাম আমি। যতবার উপরে উঠল, ঝাকের পর ঝাক মারণ-তীর আশ্রয় করে নিল তার বিশাল শরীরে। আমার এই সহানুভূতি কিন্তু এতটুকু দেখা গেলো না আমার কীর আচরণে; বরঞ্চ উত্তেজনায় টান টান, থেকে থেকে তীক্ষ্ণ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠছে সে।