এমনকি আমি পর্যন্ত এ অস্ত্র ব্যবহারে তার পারদর্শিতা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম, কিন্তু ট্যানাস হাল ছাড়েনি। ধীরে, খুবই ধীরে ওটার নিয়ন্ত্রণ পেতে শুরু করে সে, এক সময় এসে শূন্যে একটির পর একটি করে পরপর তিনটি তীর ছুঁড়তে শিখে যায়। তাদের মধ্যে অন্তত দুটি কী তিনটি টার্গেটে লাগতো। মানুষের মাথার আকারের তামার একটা চাকতি হলো টার্গেট, ট্যানাসের ছোঁড়ার জায়গা থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে । এতটাই গতিবেগ ছিলো ছোঁড়া তীরগুলোর, আমার কড়ে আঙুলের সমান পুরুত্বের তামার পাত ফুটো করে বেরিয়ে যেতো ওগুলো।
ট্যানাস অস্ত্রটার নাম রেখেছে লানাটা। মজার ব্যাপার হলো, আমার কর্ত্রীর ছোটো বয়সের নামও ছিলো সেটা। আর এখন, হাতে প্রিয় ধনুক নিয়ে নৌকার পাটাতনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে, পাশে তার মানসপ্রিয়া। কী অদ্ভুত মানিয়েছে ওদের দুজনকে। আমার মনের অশান্তি বাষ্প ছড়ায়।
চেঁচিয়ে ডাকলাম, মিসট্রেস! এখনই ফিরে আস এখানে! জলদিএমনকি কাঁধের উপর দিয়ে তাকালো না পর্যন্ত লসট্রিস; কেবল হাত দিয়ে একটা ইশারা করে দেখালো আমাকে। নৌকার সবাই দেখেছে ব্যাপারটা, জোরে হেসে ফেললো বয়োজেষ্ঠ্য কয়েকজন। ওই কালো, শয়তানের ধারী মেয়ে দুটোর কাছ থেকে নির্ঘাত এই ইশারা শিখেছে সে। নদী তীরের বর্বরদের মেয়েদের পক্ষে শোভন এমন আচরণ, প্রভু ইনটেফের মেয়ের পক্ষে নয়। একবার ভাবলাম, এটা নিয়ে তীরস্কার করবো ওকে, পরে বাদ দিলাম চিন্তাটা। আমার মিসট্রেস কখনও কখনও এ ধরনের বাজে আচরণ করে বৈকি। পরিবর্তে, মনের ঝাল মেটাতে তামার গংটা পেটাতে লাগলাম আমি।
ল্যাগুনের আয়নার মতো স্বচ্ছ পানির উপর দিয়ে ছড়িয়ে পরে কাঁপা কাঁপা, প্রতিধ্বনিত আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গেই বাতাসে ডানা মেলে ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ি; নল খাগড়ার বন আর প্যাপিরাসের ঝোঁপের আড়াল থেকে–সূর্যটাকে যেনো লুকিয়ে ফেলবে পাখির মেঘ। মুক্ত পানি, ছোটো ছোটোদের উপরের বাতাসে ডানা ঝাঁপটাতে থাকে ওগুলো বিচিত্র রকমেরঃ কালো আর সাদা আইবিস এবং শকুনের মাথার মতো নদীর দেবীর সমতুল্য বলে মনে করা হয়; বুনো রাজহাঁস–বুকের ঠিক মাঝখানটায় রক্ত লাল একটা ফোঁটা সমেত; মাঝরাতের অন্ধকারের মতো বা সবজেটে নীল হিরন। সংখ্যায় এত–দর্শকের চোখে ধাঁধা লেগে যাবে।
মিশরীয় আভিজাত্যের একটি হলো বন্য-পাখি শিকার, কিন্তু আজ সেই শিকারে আসি নি আমরা। সেই মুহূর্তে, দূরে স্বচ্ছ জলের ঠিক নিচে একটা তোলপাড় লক্ষ্য করলাম আমি। বিশাল, বিরাট কোনো জg। আনন্দে বুক কেঁপে উঠল; জানি, কীসে করেছে ওটা। ট্যানাসও দেখেছে; তবে তার অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন। হিংস্র শিকারী কুকুরের মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠে সে; তার লোকেরা প্রকম্পিত চিল্কারে দাঁড় টানতে থাকে প্রাণপণে। ঠিক আকাশ কালো করে ফেলা পাখির ঝাকের মতোই যেনো উড়তে চায় হোরাসের প্রশ্বাস, আনন্দের আতিশায্যে ছোটো একটা চিৎকার করলো আমার মিসট্রেস; ট্যানাসের উন্মুক্ত বাহুতে মুঠো করা হাত দিয়ে আঘাত করছে সে।
আবারো আলোড়িত হলো সামনের পানি, ট্যানাসের ইশারায় সেই আন্দোলনকে অনুসরণ করে দাঁড় টেনে চলে যোদ্ধারা। যেনো নিজের সাহস বা ভরসা জিইয়ে রাখতেই গংটা পিটিয়ে চললাম আমি। শেষবার যেখানে আলোড়ন দেখা গেছে, পানির উপরে ঠিক সেইখানটায় পৌঁছলাম আমরা। থেমে আছে আমাদের নৌকা; পাটাতনে দাঁড়ানো প্রতিটি মানুষ তন্ন তন্ন করে পানিতে সামান্যতম আলোড়ন খুঁজছে।
একমাত্র আমি সরাসরি স্টার্নের উপর থেকে তাকালাম। নৌকার হালের ঠিক নিচে পানি একদম অগভীর, বাতাসের মতো স্বচ্ছ, পরিষ্কার। লসট্রিসের মতো করে তীক্ষ্ণ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলাম আমাদের ঠিক নিচেই আছে দৈত্যটা!
নীল নদের দেবী হাপির বেশ নিকটাত্মীয় প্রাণী হলো জলহস্তি। কেবল তাঁর বিশেষ অনুগ্রহেই ওটা শিকার করতে পারি আমরা। সেই সকালেই অনুমতি প্রার্থনার জন্যে তার মন্দিরে বলিদান করে এসেছে ট্যানাস; লসট্রিস ছিলো তার পাশে। হাপি হলেন আমার কর্ত্রীর প্রিয় দেবী; তবে আমি নিশ্চিত, শুধু এই কারণেই প্রার্থনা অনুষ্ঠানে আগ্রহভরে যোগ দেয়নি সে।
যে জলহস্তিটা দেখেছি আমাদের নিচে, ওটা একটা বুড়ো ষাঁড়। আমার চোখে আমাদের গ্যালির মতোই বড় দেখাল ওটাকে; বিরাট একটা আকৃতি হ্রদের মেঝেতে হেলেদুলে চলেছে। স্রোতের টানে ধীর হয়ে গেছে গতিবেগ, মনে হলো যেনো দু:স্বপ্ন থেকে উঠে আসা কোনো জীব। মরুভুমির ষাড় যেমন করে দৌড়ানোর আগে খুর দিয়ে ধুলো আঁচড়ায়, তেমনি করে কাঁদার দলা গোলা পাকিয়ে উঠছে ওটার পায়ের তলা থেকে।
হাল ধরে, নৌকাটা ঘুরিয়ে নেয় ট্যানাস; বঁড়টার পেছনে ছুটতে শুরু করে হোরাসের প্রশ্বাস। কিন্তু এমনকি ধীর, হেলেদুলে চলা গতিতেও খুব দ্রুতই আমাদের নৌকা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে ওটা। সামনে, হ্রদের গভীর সবুজ জলে হারিয়ে যায় তার অবয়ব।
টানো! সেথ –এর দুর্গন্ধময় শ্বাসের কসম, টানো! দাড়ীদের উদ্দেশ্যে গর্জে উঠে ট্যানাস। কিন্তু এক পদস্থ যোদ্ধা তার হাতে চাবুক তুলে দিতে নিঃশব্দে মানা করলো সে। প্রয়োজন ছাড়া কখনও কারো উপর চাবুক চালাতে দেখিনি ওকে।
হঠাই, সামনে পানি ছেড়ে জেগে উঠে জলহস্তি ষাড়, ফুসফুঁসের ভেতর থেকে বাষ্প ছিটিয়ে দেয় হিসহিস শব্দে। এতো দূরে আছে ওটা, এরপরেও দুর্গন্ধময় শ্বাস ধুয়ে দেয় আমাদের। এক মুহূর্তের জন্যে ওটার বিশাল পেছনটা চকচকে গ্রানাইটের মতো জেগে থাকে হ্রদের পানিতে; এরপরে, বাঁশির মতো শব্দে শ্বাস টেনে আবারো ডুব দেয়।