ট্যানাসের অধস্তন একজন যোদ্ধা নৌকার মাস্ট হেডে পতাকা টানিয়ে দেয়। নীল কুমীরের ছবি মুখ হা, কাঁটাওয়ালা ভীষণ লেজটা খাড়া হয়ে আছে। দশ হাজারের সেরা উপাধি-প্রাপ্ত একজন সৈন্যেরই কেবল নিজস্ব প্রতীক টাঙানোর অধিকার আছে। ফারাও-এর নিজস্ব রাজকীয় বাহিনী, নীল কুমীরের নেতৃত্বের পাশাপাশি দশ হাজারের সেরা উপাধিও পেয়েছে ট্যানাস। বিশতম জন্মদিনের আগেই এতোকিছুর মালিক হয়েছে সে।
মাস্টহেডের ওই সংকেতের অর্থ হলো, শিকার শুরুর আহবান। দূর দিগন্তে বিন্দুর মতো অন্যান্য নৌকাগুলোর বৈঠা ছন্দোবন্ধভাবে উঠানামা শুরু করে, ঠিক যেনো আকাশে ভাসমান বুনো হাঁসের পাখার মতো; সূর্য রশ্মি চমকাচ্ছে তাদের বৈঠা থেকে ঝরে পরা পানিতে লেগে। নৌকাগুলোর পেছন থেকে উৎসারিত ছোটো ছোটো ঢেউগুলো ছড়িয়ে পরে শান্ত পানির উপর অনেকক্ষণ ধরে জেগে থাকে।
স্টার্ন থেকে গং টা বের করলো ট্যানাস, লম্বা-ব্রোঞ্জের একটা নল ওটা। প্রান্তটা। পানিতে ডুবিয়ে দেয় সে। একই ধাতুতে তৈরি একটা হাতুড়ির বাড়িতে যে শব্দ তৈরি হবে, পানির তলা দিয়ে তা পৌঁছে যাবে আমাদের শিকারের কাছে। শুরু হতে যাচ্ছে এক দক্ষ-যজ্ঞ ।
আমার উদ্দেশ্যে হাসলো ট্যানাস। এতো উত্তেজনার মধ্যেও আমার উদ্বেগ নজরে পরেছে তার। বর্বর এক যোদ্ধার বিচারে প্রচণ্ড অনুভব আছে ওর। এখানে এস, টাইটা! নির্দেশ করে সে। তুমি বরঞ্চ আমাদের পক্ষ থেকে গং টা বাজাও আজ। এতে করে তোমার সুন্দরী সম্পত্তির নিরাপত্তা নিয়ে অমূলক দুঃশ্চিন্তা থেকে রেহাই পাবে।
তার এহেন অভদ্রতায় আঘাত পেলেও স্টার্ন টাওয়ারের নিরাপদ আশ্রয় যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকলো আমাকে। ওর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় খর চোখে তাকালাম। আমার মিসট্রেসের নিরাপত্তার দিকে একটু নজর রেখ। বুঝতে পারছো তো? কোনো রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ওকে উৎসাহ দেবে না, তোমার তুলনায় কম বন্য নয় সে। ফারাও বাহিনীর বীর যোদ্ধা, দশ হাজারের সেরা উপাধিপ্রাপ্ত কারও সাথে ওই সুরে কথা বলতে পারি আমি, কেননা একদা আমার ছাত্র ছিলো সে। বহুবার শাস্তিও দিয়েছি তাকে। সেই আগের দিনগুলোর মতোই দুষ্ট হাসলো ট্যানাস।
মেয়েটাকে আমার হাতে ছেড়ে দাও, বুড়ো বন্ধু। এর চেয়ে বেশি আর কিছু কখনও চাইনি আমি, বুঝলে? টাওয়ারে উঠতে এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম, এই বেয়াদপির উপযুক্ত জবাব দেওয়া হলো না। ওখানে দাঁড়িয়ে দেখলাম, নিজের ধনুক হাতে নিচ্ছে ট্যানাস।
ইতোমধ্যেই সেনাবাহিনীতে বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছে ওই ধনুকটা। সত্যিই, সেই জলপ্রপাত থেকে শুরু করে সাগর পর্যন্ত নীল নদের তীরে সবাই জানে ওটার কথা। জিনিসটা আমি তৈরি করেছিলাম ওর জন্যে, প্রচলিত অস্ত্র সম্পর্কে বেশ বিরক্ত ছিলো সে। আমাদের নদী-বিধৌত উপত্যকায় পাওয়া দুর্বল কাঠের ধনুকের বদলে নতুন কোনো উপাদান দিয়ে তৈরির পরামর্শ দিয়েছিলাম প্রথমটায়। হয় হিটটিদের এলাকার অলিভ গাছের কাণ্ড, অথবা, কুশ দেশীয় কোনো গাছের শাখা থেকে। এমনকি, গন্ডারের শিং বা হাতির দাঁতের কথাও ভেবেছিলাম।
তৈরির প্রাথমিক পর্যায়ে দেখা গেলো, ওই সমস্ত বস্তু অত্যন্ত দৃঢ়, মোটেও নমনীয় নয়। না ভেঙে বাঁকানো এক কথায় অসম্ভব। কেবল মাত্র বিশাল কোনো হাতির শুড়ের পক্ষেই তীর টানা সম্ভব এমন ধরনের ধনুক থেকে। হাতির দাঁতের সাথে কিছুটা রুপা মিশিয়ে শেষমেষ একটা ধনুক অবশ্য বানিয়েছিলাম, কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো ওটা টানার মতো মানুষ পাওয়া সম্ভব নয়।
যা হোক, আমাদের নির্ধারিত চারটি বই একত্রে গেঁথে শেষমেষ বানানো হয়েছিলো অস্ত্রটা অলিভ গাছের কাণ্ড, ইবোনি, শুড় এবং আইভরি । বহুমাসের প্রাণান্ত পরিশ্রম, অনুশীলনের পরেই সম্ভব হলো সেটা; বিশেষ আঠা প্রয়োজন হয়েছিলো জোড়া লাগাতে। শক্তিশালী একটা আঠা খুঁজে পেতে দারুন বেগ পেতে হয়েছে, ধাতব তার দিয়ে বেঁধে সমাধান করা হয়েছিলো সমস্যাটার। আঠা গরম থাকা অবস্থাতে ট্যানাস সহ আরো দুইজন মুশকো জওয়ান লেগেছিলো তারটা বাঁকা করতে। ঠাণ্ডা হতে শক্তিমত্তা আর স্থিতিস্থাপকতার এক উৎকর্ষ নিদর্শন হলো ধনুকটা।
এরপরে বিশাল কালো কেশরওয়ালা এক সিংহের নাড়ি কেটে সংগ্রহ করেছিলাম আমি। মরুর এই হিংস্র জানোয়ারটাকে ট্যানাসই মেরেছিল ওর ব্রোঞ্জের বর্শা দিয়ে। রোদে শুকিয়ে, বেণী বেঁধে নাড়ির ওই ফিতে দিয়ে বানিয়েছি ধনুকের ছিলো; ফলে যে অসাধারণ শক্তিশালী অস্ত্র জন্ম নিলো, তা ব্যবহার করতে হলে একশ যোদ্ধার শক্তি প্রয়োজন।
তীর-বিদ্যার নিয়ম হলো, শিকারের দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে–এরপরে ছিলা টেনে নিয়ে আসতে হয় বুকের দিকে টেনে; নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধরে রেখে ছেড়ে দিতে হয় তীর। কিন্তু এমনকি ওই ধনুক টেনে ধরে রাখা ট্যানাসের পক্ষেও সম্ভব ছিলো না; নতুন এক ধরন আবিষ্কার করতে হলো তাকে। শিকারের মুখোমুখি না দাঁড়িয়ে, পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে তীর চালনা; প্রসারিত বাঁ হাতে ধনুকটা রেখে ক্রমাগত টেনে চলা যতক্ষণ পর্যন্ত না তীরের পালক তার ঠোঁট ছোয়; এরপরে, যেনো তাক না করেই তীর ছেড়ে দেয় সে। হাত এবং বুকের মাংস পেশীর অকল্পনীয় জোর প্রয়োজন এমন কৌশলে।
প্রথমটায় চাক ভেঙে ছুটে চলা মৌমাছির মতোই দিক-বিদিগ ছুটত ট্যানাসের ছোঁড়া তীর, কিন্তু দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পরিশ্রম করে গেলো সে। ধনুকের ছিলার ঘর্ষণে ডান হাতের আঙুলগুলো রক্তাক্ত হলো, কিন্তু চালিয়ে গেলো সে। তীর ছোঁড়ার সময়ের ঘষায় বাঁ হাতের ভেতরের অংশ কালো হয়ে গেছিল, পরে চামড়ার একটা আবরণ বানিয়ে দিয়েছিলো আমি সেজন্যে। আর অনুশীলনের ধারা অব্যাহত রেখেছিলো ট্যানাস।