বাবা কিছুতেই নাটক হতে দেবেন না।
কোন উপায় নেই তাঁর হাতে, ফারাও-এর কু-নজরে যদি পড়তে না চান, তবে অবশ্যই আমার নাট্যগীতি তাঁকে দেখতেই হবে। এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকো।
ট্যানাসকে বাইরে পাঠিয়ে, অন্য কাউকে দিয়ে হোরাস-এর ভূমিকায় অভিনয় করাবেন তিনি, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে লসট্রিস।
অন্য একজন অভিনেতার অনুশীলন করার সময় নেই। ট্যানাসই দেবতা হোরাসের ভূমিকায় থাকবে। আমার মনিব, ইনটেফকে এ বিষয়ে বলবো আমি। তুমি আর ট্যানাস কথা বলার সুযোগ পাবে। তোমাদের জন্যে একটা উপায় বের করবো আমি।
কান্না গিলে ফেলে সম্পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে মুখ তুলে চাইল লসট্রিস। ওহ, টাইটা! আমি জানি, একটা না একটা উপায় তুমি বের করবেই। সবসময় তাই করো আচমকা থেমে গেলো সে, মুখভঙ্গি পাল্টে গেছে। আমার পিঠে ঘুরছে তার হাত, র্যাসফারের চাবুকের আঘাত যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার প্রান্তে লেগেছে আঙুল।
আমি দুঃখিত, মিসট্রেস। ট্যানাসের প্রস্তাব দিয়েছিলাম, যেমনটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোমাকে। আর এ সব কিছুই আমার গাধামীর ফল।
আমার পেছনে এসে দাঁড়াল ও, হালকা লিনেনের টিউনিকটা উঁচু করে ধরল–ওটা দিয়ে আড়াল করে রেখেছিলাম আঘাতের চিহ্ন। আঁতকে উঠে লসট্রিস। এটা র্যাসফারের কাজ। ওহ, প্রিয় টাইটা, আমাকে কেন আগে বলে নি, আমার আর ট্যানাসের প্রতি বাবার এতে ক্ষোভ?
এহেন বাজে অভিযোগে উত্তর না করতে মনস্থ করলাম আমি, কতবার বলতে চেয়েছি কথাটা যে, ইনটেফ মোটেও ভালো চোখে দেখবেন না ট্যানাসকে? দারুন দপদপ করছে পিঠের ক্ষতগুলো, তবু চুপ করে রইলাম।
আমার এই বাহ্যিক আঘাতে অন্তত লসট্রিস কিছু সময়ের জন্যে হলেও ভুলে গেছে নিজের দুর্দশা । বিছানায় বসার জন্যে আদেশ করলো সে, আমি পালন করতে টিউনিক খুলে নিয়ে পরিচর্যা শুরু করলো ক্ষতের। খাঁটি ভালোবাসা আর আবেগশূন্য স্থান পূরণ করলো তার অপরিণত প্রচেষ্টার। নিজের দুঃখের কথা এখন ভুলে গেছে মেয়েটা। কিছু সময়ের মধ্যেই কলকল করতে লাগলো সে, কেমন করে তার বাবার রাগ পেরিয়ে ট্যানাসের সঙ্গে মিলিত হবে–এইসব।
এর কিছু কিছু পরিকল্পনা তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিল, বাকিগুলো মূলত তারুণ্য আর দুনিয়ার তাবৎ দুষ্ট-অভিজ্ঞতায় অনভিজ্ঞতার কথাই যেনো প্রমাণ করলো। গীতি নাট্যে আইসিস-এর ভূমিকায় এতো সুন্দর অভিনয় করবো, এক পর্যায়ে এসে বললো লসট্রিস, ফারাও এতো খুশি হবেন, আমি যা চাই–তাই মেনে নেবেন। এরপর, ট্যানাসকে আমার স্বামী হিসেবে তাঁর কাছে প্রার্থনা করবো আমি, আর তিনি বলবেন এবারে রাজার ধীরলয়ের গুরুগম্ভীর উচ্চারণ এমন দক্ষতার সাথে নকল করলো সে, না হেসে পারলাম না আমি। তিনি বলবেন–লর্ড হেরাব, পিয়াংকির পুত্র ট্যানাসের সাথে উজির কন্যা, লেডি লসট্রিসের বিবাহের ঘোষণা দিচ্ছি আমি। আর আমার বিশ্বস্ত ভৃত্য, ট্যানাসকে মিশরের মহান সিংহ উপাধিতে ভূষিত করলাম, এর ফলে আমার সমস্ত বাহিনীর সেনাপতি হলো সে। আরও ঘোষণা করছি, তার বাবা, পিয়াংকি, লর্ড হেরাবের সমুদয় সম্পত্তি তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক এখানে এসে থেমে যায়, আমার আঘাতের পরিচর্যা শেষে গলা জড়িয়ে ধরলো লসট্রিস।
এমনকি হতে পারে না, টাইটা? বলো না, পারে না এমন হতে!
কোন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে তোমাকে অবজ্ঞা করা সম্ভব নয়, মিসট্রেস, ওর বোকামীতে হাসলাম আমি। এমনকি মহান ফারাও পর্যন্ত নন। তখন যদি জানতাম, সত্যির কত কাছাকাছি বলে ফেলছি, নির্ঘাত জ্বলন্ত কয়লার টুকরো রাখতাম নিজের জিভে।
আশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো লসট্রিসের মুখ। আমার জন্যে এর বেশি আর কি চাইবো, টিউনিকটা পরে নিয়ে ওর পরিচর্যায় ইতি টানলাম।
কিন্তু, এখন, মিসট্রেস; যদি সত্যিই অপরূপা আর অপ্রতিরোধ্য একজন আইসিস হতে চাও, তোমাকে বিশ্রাম নিতে হবে। লাল শেপেনের পাতা থেকে তৈরি ঘুমের গুড়ো নিয়ে এসেছিলাম সাথে করে, পুবের কোনো দূরদেশ থেকে এই ফুলের বীজ নিয়ে এসেছিল ব্যবসায়ী ক্যারাভান। আমার বাগানে এখন এই লাল-ফুলের চাষ করি, ঝরা পাতা থেকে স্বর্ণের তৈরি কাঁটা দিয়ে নেড়ে আমার নিজস্ব উপায়ে তৈরি করি গুড়ো। ঘুম আনে এই দ্রব্য, ব্যথা দূর করে, অদ্ভুত সব স্বপ্নও দেখায়।
আমার সাথে কিছুক্ষণ থাকো না, টাইটা, ঘুমকাতুর মুরগির ছানার মতো বিছানায় কুঁকড়ে আসে লসট্রিস, ঘুম পাড়িয়ে দাও, বাচ্চা ছিলাম যখন, তখনকার মতো করে। ও তো এখনও একটা বাচ্চা, কোলে নিতে নিতে মনে মনে ভাবলাম আমি।
সব ঠিক হয়ে যাবে, তাই না টাইটা? ফিসফিস করে বললো সে। সুখে-শান্তিতে চিরকাল বাস করবো আমরা, ঠিক তোমার গল্পের মত, করবো না, বলো টাইটা?
ও ঘুমিয়ে গেলে, কপালে নরম করে চুমো খেলাম আমি। পশমের একটা চাদর দিয়ে গা ঢেকে চুপি চুপি বেরিয়ে এলাম ওর কক্ষ ছেড়ে।
*
ওসিরিসের উৎসবের পঞ্চম দিনে গজ-দ্বীপে, নিজের প্রাসাদ ছেড়ে নদীর উজানে কারনাকে এলেন ফারাও; দ্রুতগামী গ্যালিতে দশ দিনের পথ পাড়ি দিয়ে। সমস্ত রাজকীয় সভাসদ সঙ্গে করে নিয়ে আসেন তিনি, যাতে করে পূর্ণ মর্যাদায় পালিত হয় উৎসব।
তিন দিন আগেই কারনাক ত্যাগ করেছে ট্যানাসের বাহিনী, নদীর উজানে দ্রুত এগিয়ে মিলিত হয়েছে রাজকীয় নৌবহরের সাথে, যাত্রার শেষভাগে পাহারা দিয়ে নিয়ে এসেছে ফারাওকে। হাপির ল্যাগুনে সেই জলহস্তি শিকারের পর থেকে আমি বা লসট্রিস, কেউ তার দেখা পাই নি। শক্তিশালী স্রোত আর মরুর বাতাসে প্রায় উড়ে নদীর শেষ বাঁক ঘুরে যখন দৃশ্যমান হলো তার জাহাজ, খুশি ধরে রাখতে পারলাম না আমি এবং লসট্রিস। দক্ষিণ দিক হতে রাজকীয় নৌবহরের নেতৃত্ব দিয়েছে হোরাসের প্রশ্বাস।