দুই! চেঁচিয়ে উঠলো সে, তীক্ষ্ণ চিৎকার করে এলিয়ে পড়লাম আমি।
*
আমার প্রকোষ্ঠের প্রবেশমুখের চওড়া চাতালে অপেক্ষায় বসেছিলো লসট্রিসের একটা দাসী মেয়ে, বাগানের ধাপ টপকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে উঠলাম আমি।
আমার মনিব এখনই আপনার সঙ্গ চাইছেন, মেয়েটা জানাল
আমাকে। তাকে গিয়ে বলল, আমি অসুস্থ, সমন এড়িয়ে যেতে চাইলাম আমি। আঘাতগুলো পরিচর্যার জন্যে চিৎকার করে দাস বালকদের ডাকতে ডাকতে ঢুকে পড়লাম আমার প্রকোষ্ঠে । এই মুহূর্তে লসট্রিসের মুখোমুখি হতে পারব না, কিছুতেই ব্যর্থতার কথা বলা যাবে না তাকে। কেমন করে তাকে ট্যানাসের প্রতি তার ভালোবাসার অসারত্ব বোঝাবো? কালো দাসী মেয়েটা অনুসরণ করে ভেতরে ঢুকে পরেছে, উন্মুক্ত পিঠের দারুন আঘাতগুলো এখন দেখছে আতঙ্ক নিয়ে।
যাও, তোমার মনিবকে গিয়ে বলো আমি আঘাতপ্রাপ্ত, এখন তার সাথে দেখা করতে পারব না, কাঁধের উপর দিয়ে তিক্তস্বরে বললাম।
তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন, আপনি নানা অজুহাতে আসতে চাইবেন না; আমি যেনো সাথে করে নিয়ে যাই আপনাকে।
তুমি একটা বেয়াদব মেয়ে, ভর্ৎসনা করে বললাম মেয়েটাকে। একজন দাস বালক আমারই তৈরি মলম লাগিয়ে পরিচর্যা করতে লাগলো পিঠের আঘাতগুলোয়।
হ্যাঁ, ঝলমলে হাসির সাথে মেনে নিল সে। আপনিও তাই। আমার একটা অর্ধ চড় অনায়াসে এড়াল মেয়েটা। দাসী-পরিচর্যাকারীদের প্রতি লসট্রিস দারুন সদয় ।
যাও, গিয়ে বলো আমি আসছি, এবারে বললাম।
উনি বলে দিয়েছেন, আমি যেনো অপেক্ষা করে দেখি আপনি যান কিনা।
তো, হারেমের রক্ষীদের অতিক্রম করে যাওয়ার সময় একজন প্রহরী হয়ে মেয়েটা রইল আমার সাথে। রক্ষীরা সবাই আমারই মতো খোঁজা; তবে ব্যতিক্রম হলো এরা সবাই মোটা এবং উভলিঙ্গিক। দেহের বিশাল আকৃতির কারণেই হয়তো, দারুন শক্তিশালী মানুষ ওরা, ভীষণ হিংস্র। যাই হোক, আমার প্রভাব বলে এদের কাছ থেকে সম্মান আদায় করে নিতে সমর্থ হয়েছি, মেয়েদের প্রকোষ্ঠে একটা সালামের সাথে ঢুকতে দেওয়া হলো আমাকে।
দাস বালকদের থাকার জায়গার এতো আরামদায়ক বা পরিচ্ছন্ন নয় হারেম, বোঝাই যায় আমার মনিবের আগ্রহ কোনো দিকে। কাদার ইটে তৈরি ছোট্ট কুঁড়েঘর, উঁচু কাঁদায় তৈরি দেয়ালে ঘেরা। একমাত্র বাগান বা সাজ বলতে লসট্রিস আর তার দাসীদের হাতে তৈরি বাগান, আমার সহায়তায় করা হয়েছে সেটা। উজিরের পত্নীরা সবাই অলস আর স্কুল; হারেমের ষড়যন্ত্র, কেলেঙ্কারী নিয়েই তাদের যত মাতামাতি ।
প্রধান ফটকের কাছেই লসট্রিসের বাসভবন; সুন্দর পদ্ম-ফোঁটা পুকুর চারদিকে। বাঁশের খুঁচায় বিচিত্র স্বরে গাইছে পাখির দল। কাঁদার দেয়ালে নীল নদের উজ্জ্বল দৃশ্যাবলি আঁকা; মাছ, পাখি আর নদীর দেবীর ছবি–ওকে আঁকতে সাহায্য করেছিলাম আমি।
প্রবেশমুখে বিষণ্ণ দলে জড়ো হয়ে বসে আছে লসট্রিসের দাসী মেয়েদের দল; অনেকেই কাঁদছে। কান্নার জলে মুখ ভেজা তাদের। ওদের ঠেলে সরিয়ে অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা, অন্ধকারাচ্ছন্ন ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি। কোনো একটা কক্ষ হতে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে আমার মিসট্রেসের। দ্রুত এগুলাম, ওকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছি বলে লজ্জা লাগছে এখন।
নিচু একটা বিছানায় মুখ নামিয়ে কাঁদছিলো লসট্রিস, কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে পুরো শরীর; কিন্তু আমার ঢোকার শব্দ শুনে ঘুরে, এক ঝটকায় বিছানা ছেড়ে নেমে দৌড়ে এলো সে।
ওহ, টাইটা! ওরা ট্যানাসকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফারাও কাল কারানাকে আসবেন, আমার বাবা তাকে অনুরোধ করতে যাচ্ছেন ট্যানাসকে যেনো বাহিনী সহ নদীর উজানে, সেই গজ-দ্বীপ আর জলপ্রপাতের ওপারে পাঠানো হয়। ওহ, টাইটা! প্রথম জলপ্রপাত এখান থেকে বিশদিনের পথ। আর কখনও ওকে দেখতে পাবো না আমি। মরে যাওয়াও ভালো ছিলো এর থেকে। নীল নদির পানিতে ঝাঁপিয়ে কুমীরের খাবার হব আমি। ট্যানাসকে ছাড়া বেঁচে থেকে কী হবে একসঙ্গে বলে থামল লসট্রিস।
আস্তে, ছোট্ট সোনা, আলিঙ্গনের ভেতর ওকে অল্প অল্প দোলালাম। এত ভয়ঙ্কর সবকথা তুমি জানলে কেমন করে? এগুলো তো নাও হতে পারে।
ওহ, ঘটবে, টাইটা। ট্যানাস একটা বার্তা পাঠিয়েছে আমাকে। বাবার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের মধ্যে কাতাসের ভাই আছে। সে-ই শুনেছে রাসফারের সঙ্গে এই নিয়ে আলাপ করছিলেন বাবা । জানি না কেমন করে, আমার আর ট্যানাসের সবকিছু বাবা জেনে গেছেন। উনি জানেন, হাপির মন্দিরে একা ছিলাম আমরা। ওহ টাইটা, বাবা মন্দিরের পুরোহিতদের পাঠিয়েছিলেন আমাকে পরীক্ষা করে দেখতে। ওই নোংরা বুড়োগুলো ভীষণ কাজ করেছে আমার সাথে। ব্যথা পেয়েছি আমি, অনেক।
আস্তে করে ওকে আলিঙ্গন করলাম। এমন নয় যে সবসময় এটা করার সুযোগ পাই আমি, কিন্তু আজ সজোরে আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রত্যুত্তর করলো লসট্রিস। নিজের আঘাতের থেকে প্রেমিকের দিকে বয়ে গেলো তার চিন্তাধারা।
আর কোনোদিন আমি ট্যানাসকে দেখতে পাবো না, কেঁদে ফেলল লসট্রিস। কত ছোটো মেয়েটা এখনও, শিশুই বলা যায়, ক্ষোভে-দুঃখে ভগ্ন-হৃদয়। বাবা ওকে শেষ করে দেবে।
এমনকি তোমার বাবাও পারবে না সেটা, ওকে প্রবোধ দিতে চাইলাম। ফারাও এর নিজস্ব রাজকীয় রক্ষী বাহিনীর সেনাপতি ট্যানাস। রাজার লোক সে। কেবল মাত্র ফারাওয়ের কাছ থেকে নির্দেশ নেয় ট্যানাস, মিশরের দ্বৈত-মুকুটের সমস্ত সম্মান তার প্রাপ্য। ওকে বললাম না, সম্ভবত এই কারণেই এখনও ইনটে ধ্বংস করে দেয় নি তাকে। বলে চললাম, ট্যানাসকে আর দেখবে না কী বলছো, গীতিনাটকে ওর বিপরীতেই তো অভিনয় করছো তুমি । দৃশ্যের বিরতিতে তোমরা দুজন যেনো একা কথা বলতে পারো, সে ব্যবস্থা আমি করবো।