রাত নেমে আসতে শয্যা কক্ষে নিয়ে গেলাম ওকে। লিনেন চাদরের উপর মাথা রেখে আমার দিকে চাইলো ও, ফিসফিস করে বললো, টাইটা, শেষবারের মতো, একবার আমার জন্যে আমন রা ইন্দ্রাজাল অনুশীলন করবে?
মিসট্রেস, তোমার জন্যে যে কোনো কিছু করতে রাজী আমি। মাথা ঝুঁকিয়ে ওষুধের বাক্স আনতে চললাম।
ওর পাশে এসে বসলাম আমি, ধীরে প্রস্তুত করতে শুরু করলাম লতা-গুলোর মিশ্রন। পানিতে ঢেলে, একটা পাত্রে নিয়ে গরম করতে লাগলাম।
গরম হতে, পাত্র উঁচিয়ে সালাম জানালাম আমার রাণীকে, এরপর পান করে নিলাম মিশ্রণটা।
ধন্যবাদ, ফিসফিস স্বরে বললো লসট্রিস। চোখ বন্ধ করে, আতঙ্কের সাথে এই বাস্তব জগৎ ছেড়ে আত্মার নির্গমণের অপেক্ষায় বসে রইলাম আমি। সেই জগতে যেখানে স্বপ্নরা ভবিষ্যৎ দেখায়–ঘুরে ফিরলাম।
যখন ফিরে এলাম আমি ঘোর ভেঙে, প্রদীপের আলো নিভে গেছে। নিস্তব্ধ পুরো প্রাসাদ। বাগানের নাইটিঙেলের গান ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। সিল্কের বালিশে মাথা রেখে মৃদু স্বরে শ্বাস নিচ্ছে আমার মিসট্রেস।
ভেবেছিলাম, বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছে সে। কিন্তু মুখের ঘাম মুছে নিতে, চোখ মেলে চাইলো সে। ওহ্ টাইটা, খুব কষ্ট হয়েছে না?
আগের যেকোনো বারের চেয়ে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি আমি। মাথা ব্যথায় যেনো ছিঁড়ে যাবে। চোখে দেখছি না ঠিকমতো। শেষবারের মতো এই অনুশীলন করলাম আমি। আর কখনো, কোনে দিনও করবো না।
আমি দেখলাম নদীর দুই তীরে দাঁড়িয়ে আছে শকুন আর কোব্রা। জলরেখা বিভক্ত করে রেখেছে তাদের। একশ বার পানির স্তর উঁচু আর নিচু হলো আমার সামনে। আমি দেখলাম, একশ থলে শস্যদানা, একশ পাখি উড়ে গেলো নদীর উপর দিয়ে। ওদের নিচে, যুদ্ধে সৃষ্ট ধুলোর মেঘ আর তরবারীর ঝনঝনানি। শহরের পর শহরে জ্বলছে আগুন।
শেষমেষ, একত্র হলো শকুন আর কেব্রা। বিশুদ্ধ নীল কাপড়ের উপর সঙ্গমে মিলিত হলো তারা। শহরের দেয়ালে দেয়ারে শোভা পেলো নীল পতাকা, মন্দিরের ছাতে উড়লো নীল তোড়ন।
রথের শীর্ষে উড়লো নীল পতাকা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো সেই রথ। এতো লম্বা আর শক্তিশালী মূর্তি দেখলাম, এক হাজার বছরেও যার ক্ষয় হবে না। আমি দেখেছি, পঞ্চাশ জাতির মানুষজন মাথা ঝোকায় তার সম্মুখে।
মাথার চুল খামচে ধরলাম আমি ব্যথায়। বহুকষ্টে উচ্চারণ করলাম, এই ছিলো আমার স্বপ্ন।
বহুক্ষণ কথা বললাম কেউ। এরপর, শান্ত স্বরে আমার কর্ত্রী বললো, একশ বছর পরে একত্র হবে দুই রাজ্য। একশ বছরের যুদ্ধ আর বঞ্চনা শেষে আমাদের এই পবিত্র মিশর থেকে চলে যাবে হিকসস্। আমার লোকেদের জন্যে দারুন কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
কিন্তু নীল পতাকাতলে এক হবে তারা, আর তোমারই বংশধারা এই পৃথিবী শাসন করবে একদিন। এই পৃথিবীর সমস্ত জাতি সম্মান জানাবে তাঁকে। স্বপ্নের শেষটা শোনালাম আমি ওকে।
আমি তৃপ্ত ওটা জেনে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো লসট্রিস। ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলো সে।
আমি ঘুমালাম না। জানি, আমাকে প্রয়োজন মিসট্রেসের।
সূর্যোদয়ের ঠিক আগে, রাতের সবচেয়ে অন্ধকার সময়ে জেগে উঠলো ও। চিৎকার করে বললো, ব্যথা! দয়াময়ী আইসিস, কী ব্যথা!
লাল শেপেনের গুড়ো দিলাম ওকে। কিছুসময় পর ও বললো, ব্যথা নেই আর। কিন্তু ঠাণ্ডা হয়ে গেছি আমি। আমাকে ধরে থাকো, টাইটা, তোমার শরীর দিয়ে উষ্ণতা দাও।
আমার বাহুবন্ধনে আবারো ঘুমিয়ে পড়লো মিসট্রেস।
চাতালে যখন প্রথম সূর্যরশ্মি চমকাচ্ছে, জেগে উঠলো লসট্রিস।
জীবনে কেবল দু জন মানুষকেই ভালোবেসেছিলাম আমি, ফিসফিস করে উচ্চারণ করলো শব্দ কটা। তুমি ছিলে তাদের একজন। হয়তো, পরের জীবনে আমাদের এই ভালোবাসায় দেবতারা আরো একটু সদয় হবেন।
কোনো উত্তর জোগালো না ঠোঁটে। শেষবারের মতো চোখ মুদলো আমার মিসট্রেস। শান্তভাবে, কিছু বুঝতে না দিয়ে চলে গেলো ও। শেষ নিঃশ্বাসের কোনো পার্থক্য রইলো না তার আগেরটির সঙ্গে। ঠোঁটে চুমো খেতে গিয়ে ঠান্ডা স্পর্শ টের পেলাম আমি ।
বিদায়, মিসট্রেস, বিড়বিড় করে বললাম। বিদায়, ভালোবাসা।
*
রাজকীয় শবদেহপ্রস্তুতির সত্তর দিবস-রজনীতে এই স্ক্রোলগুলো লিখেছি আমি। এ হলো মিসট্রেসের প্রতি আমার শেষ নিবেদন।
মৃতের পরিচর্যাকারীরা আমার কাছ থেকে ওকে নিয়ে যাওয়ার আগে, ট্যানাসের মতো ওর দেহের একপাশ কেটে, গর্ভের ভেতর থেকে বের করে আনলাম সেই বিষাক্ত মাংসপিন্ড–যা ওর মৃত্যুর জন্যে দায়ী। রক্তমাংসের সেই বস্তু মানবসৃষ্ট নয়–নৃশংস দেবতা সেথ-কে অভিসম্পাত দিয়ে ওটাকে আগুনে ছুঁড়ে ফেললাম।
এই স্ক্রোলগুলো সংরক্ষণের জন্যে দশটি অ্যালাবাস্টারের পাত্র তৈরি করেছি আমি। ওর সাথেই থাকবে এগুলো। ওর সমাধির দেয়ালচিত্র আঁকছি এখন, আমার সৃষ্টি সেরা চিত্রকর্ম হবে সেগুলো। তুলির প্রতিটি ছোঁয়া, লসট্রিসের প্রতি আমার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
ইচ্ছে হয়, চিরকাল ওর সাথে শুয়ে থাকি কবরে; দুঃখ-শোক আমাকে অসুস্থ করে ফেলছে। কিন্তু এখনো রাজা আর রাজকুমারীরা রয়েছে যে।
ওদের আমাকে প্রয়োজন।
-: (শেষ) :-
*
অনুবাদকের পাদটিকা : রিভার গড-এর কাহিনীর এখানেই পরিসমাপ্তি। রাণীর মৃত্যুতে দুঃখ-শোকে পাথর টাইটা পরবর্তীতে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে বেছে নিয়েছিলো সন্ন্যাস জীবন। বহু বছর আধুতিক শক্তির আরাধনা করে নিজেকে উন্নিত করেছিলো অতিন্দ্রিক শক্তির অধিকারী জাদুকর হিসেবে। পরবর্তীতে অবশ্য রাণী লসট্রিসের নাতী, নেফারের আহ্বানে মিশরে প্রত্যাবর্তন করেছিলো সে। ও হ্যাঁ, উদ্ধার করা হয়েছিলো ফারাও মামোসের বিপুল পরিমাণ সমাধি-সম্পদও। কিন্তু সে ভিন্ন গল্প, ভিন্ন কাহিনী। সময় সুযোগ হলে পরে কখনো না হয় বলা যাবে পাঠককে!
–অনুবাদক।