একটা রথ আর তাজা ঘোড়া ব্যবস্থা করে দিলো হুই। আমি তোমার সাথে যাই, টাইটা? অনুমতি প্রার্থনা করলো সে।
না,মাথা নেড়ে বাঁধা দিলাম। একা বরঞ্চ দ্রুত যেতে পারবো। যাও, শহরে গিয়ে আনন্দ করো তুমি। হাজারো কুমারী মেয়ে তোমার অপেক্ষায় আছে ওখানে! যাও!
দক্ষিণের রাস্তা ধরার আগে প্রথমে যুদ্ধক্ষেত্রে রথ চালিয়ে গেলাম আমি। শিয়াল আর হায়েনার দল ইতোমধ্যেই তাদের ভোজ শুরু করে দিয়েছে, আহতের আর্তনাদ ছাপিয়ে উঠছে তাদের গোঙানি আর হুঙ্কার ।
যেখানে শেষ দেখেছিলাম ক্ৰাতাসকে, সেইদিকে রথ চালিয়ে যেতে চাইলাম আমি। কিন্তু সবচেয়ে মর্মান্তিক অবস্থা এখানকার ময়দানে। রথের চাকার সমান উঁচু হয়ে আছে নিহতের দেহ। রক্তে ভেঁজা, থকথকে কাদামাটির মধ্যে পরে থাকতে দেখলাম ওর শিরস্ত্রাণ। রথ থেকে নেমে, ওটা হাতে তুলে নিলাম আমি। তুবড়ে, বেঁকে-চুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে জিনিসটা।
ছুঁড়ে ফেলে, ক্রাতাসের খোঁজে পাগলের মতো এদিক-সেদিক চাইতে লাগলাম। এক স্তূপ মরদেহের নিচ থেকে বিবাট একাশিয়া শাখার মতো বেরিয়ে আছে একটা পা। শিলুক আর হিকসস্ জড়াজড়ি করে মরে পরে আছে। পা ধরে টেনে বের করলাম দেহটা–এ যে ক্ৰাতাস। শুকনো বক্তে মাখামাখি, মুখে-চুলে শক্ত হয়ে কাঁদার মতো লেপ্টে আছে রক্ত।
পাশে ঝুঁকে বসে, বিড়বিড় করে বললাম, সবাইকে মরতে হবে–প্রতিটি প্রাণ, যা ভালোবাসি আমি? ঝুঁকে পরে ক্রাতাসের রক্ত লেপ্টানো ঠোঁটে চুমো খেলাম।
বসে পড়ে, আমার দিকে তাকালো সে। চওড়া হাসছে। সেথ্-এর বাম নাকে জমে থাকা ময়লার কসম! একেই বলে লড়াই!
ক্ৰাতাস! অবিশ্বাসে গর্জে উঠলাম । তুমি আসলেই বেঁচে আছো?
এ নিয়ে সন্দেহ করো না, ব্যাটা বর্বর। তবে এই মুহূর্তে একটু মদ প্রয়োজন!
ছুটে, রথের ভেতর থেকে সুরার পাত্র নিয়ে এসে ওর ঠোঁটে তুলে দিলাম। পুরোটা পানীয় ঢকঢক করে গিলে ফেলে, বিরাট এক ঢেঁকুর তুললো ক্ৰাতাস।
এখনকার মতো চলবে, আমাকে চোখ মেরে বললো বর্বরটা। এবারে, সবচেয়ে কাছের মেয়েদের ভেঁরাটা কোথায় আছে, একটু চিনিয়ে দেবে?
*
দ্রুতগতির গ্যালির চেয়েও দ্রুত গজদ্বীপে আমাদের বিজয়ের সংবাদ নিয়ে গেলাম আমি। একজন মানুষ নিয়ে প্রাণপণ ছুটলো ঘোড়া দুটো। পথিমধ্যে প্রতিটি গ্রামে চিৎকার করে পৌঁছে দিলাম সেই সংবাদ, বিজয়! আমরা জিতেছি! ফারাও-এর জয় হয়েছে। থিবেস-এ! তাড়িয়ে দিয়েছি আমরা হিকসস্ দের!
সমস্ত প্রশংসা দেবতাদের জন্যে! অভিভাদন জানালো জনতা। মিশর আর টামোস!
ছুটে চললাম আমি। আজো সেই ঘোড়দৌড়ের কথা স্মরণ করে মিশরের জনতা। তারা বলে, রক্তলাল চোখে, রুগ্ন এক ঘোড়সওযার শুকনো রক্তমাখা আলখাল্লা পরে, বিশাল চুল বাতাসে উড়িয়ে বিজয়ের খবর পৌঁছে দিয়েছিলো গজদ্বীপে।
দুই দিন এবং দুই রাত দৌড়ে থিবেস থেকে গজদ্বীপে পৌঁছেছিলাম আমি। শেষমেষ যখন প্রাসাদের সামনে এসেছিলাম, আর শক্তি ছিলো না শরীরে। বহু কষ্টে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে জলবাগানে, আমার কর্ত্রীর শয্যাপাশে গিয়ে পরে গিয়েছিলাম।
মিসট্রেস, শুকনো গলায়, ফাটা ঠোঁটে কোনোমতে বললাম। বিজয় অর্জণ করেছেন ফারাও। আমি বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছি তোমাকে।
*
জাহাজে চড়ে নদীর ভাটিতে থিবেস-অভিমুখে চললাম আমরা। দুই রাজুমারী সাথে ছিলো তাদের মায়ের যত্ন-আত্তির জন্যে। খোলা পাটাতনে ওর সঙ্গে বসে গাইলো তারা। বুকের গভীরে অসুস্থ মায়ের জন্যে শোক আগলে রেখে হাসি মুখে ধাঁধা আর গল্পের হাস্যরস বইয়ে দিলো।
আহত পাখির মতোই দুর্বল তখন রাণী লসট্রিস। কোনো ওজন নেই তার দেহে; শুকিয়ে গেছে শরীরের সমস্ত হাড়-মাংস। স্বচ্ছ, ফ্যাকাসে ত্বকে কোনো প্রাণ নেই । দশ বছর বয়সী ওর মতো সহজেই বহন করতে পারি আমি তার দেহ। ঘুমের গুঁড়ো আর তার ব্যথা কমাতে পারে না। পেটের গভীরের সেই মাংসপিন্ড শেষ করে দিয়েছে। তাকে।
নদীর শেষ বাঁকে যখন থিবেস-নগরীর দেয়াল দেখা যেতে শুরু করলো, কোলে তুলে ওকে বয়ে নিয়ে গেলাম গলুইয়ে । এক হাত দিয়ে অবলম্বন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলাম। তরুণ বয়সের কতো শতো না স্মৃতি খেলে যাচ্ছিলো মানসপটে।
একটু নড়াচড়াতেই ক্লান্ত হয়ে পড়লো লসট্রিস। মেমননের প্রাসাদের ঘাটে যখন নোঙর ফেললাম আমরা, থিবেস-এর সমস্ত জনতা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো রাণীকে অভিবাদন জানাতে। সবার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফারাও টামোস।
খাঁটিয়ায় করে তাকে বয়ে নিয়ে চললো যোদ্ধারা। যদিও এর আগে থিবেস-এর অনেকেই দেখেনি আমার কর্ত্রীকে, কিংবদন্তি হয়ে আছে রাণী লসট্রিসের গল্প। ওর আশীর্বাদ পাবার জন্যে ছোটো ছোটো বাচ্চাদের উচিয়ে ধরলো মায়েবা, যেনো লসট্রিসের এতোটুকু ছোঁয়া পেলে দেবতার কৃপা পাবে।
মাতা হাপির কাছে আমাদের জন্যে প্রার্থনা করবেন, আবেদন ঝরে পড়লো তাদের কণ্ঠে। আমাদের আশীর্বাদ করুন মিশর-মাতা।
প্রধান সমরনায়কের সন্তানের মতো খাঁটিয়ার পাশে পাশে হেঁটে চললেন ফারাও টামোস, তেহুতি এবং বেকাথা থাকলো একটু পিছনে। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে উজ্জ্বল হাসলো ওরা।
আতন শয্যাকক্ষ প্রস্তুত করে রেখেছিলো রাণীর জন্যে। দরোজার কাছে এসে সবাইকে, এমনকি রাজাকেও তাড়িয়ে দিলাম আমি। চাতালে, বিছানা টেনে এনে শুইয়ে দিলাম আমি ওকে। ওখান থেকে শহরের দেয়াল আর প্রিয় নীলনদ দেখতে পাবে আমার কর্ত্রী।