আপাচান সুদক্ষ তলোয়ারবাজ। কিন্তু নীল সেই অস্ত্রের কোনো জুরি নেই। ঢাল সামলে নিয়ে, পরবর্তী আঘাত হানলো মেমনন। নীল তলোয়ারের ফলা আপাচানের অস্ত্রের ফলায় বাড়ি খেলো। সাথে সাথে তামার ফলা সম্পূর্ণ ভেদ করে বেরিয়ে গেলো ওটা; শুধুমাত্র তার অস্ত্রের হাতল রইলো আপাচানের হাতে।
অবাক বিস্ময়ে বিকট গর্জন ছাড়লো সে। ধ্রুপদি ঢঙে লড়াই শেষ করলো মেম। আপাচানের খোলা মুখে সোজা সেঁধিয়ে দিলো তলোয়ারের ডগা-গলা ছিঁড়ে ফুড়ে বেরিয়ে গেলো সেটা। রক্তের স্রোতে বন্ধ হয়ে গেলো এশীয় বর্বরের শেষ আর্তনাদ।
আংটা খুলে দিতে মুক্ত হয়ে গেলো হিকসস্ রথ। এলোমেলো ভঙ্গিতে ছুটতে লাগলো নিয়ন্ত্রণহীন রথ। রক্তের জলপ্রপাত ঝরছে যেনো আপাচানের মুখ থেকে, রথের কাঠামো আঁকড়ে ধরে মরে গেলো সে।
অসহনীয় সেই দৃশ্য সহ্য করতে পারলো না হিকসস্ রথ চালকেরা। ঘোড়া থামিয়ে লড়াই ছেড়ে দিলো।
এখনো শেষ হয়নি লড়াই, মেমননকে সতর্ক করে দিয়ে বললাম। আপাচানের রথ বহর ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু বিউন-এর বাহিনী বাকি আছে এখনো।
ক্রাতাসের কাছে নিয়ে চলো আমাকে।
শিলুকদের বাহিনী নিয়ে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষায় আছে ক্ৰাতাস।
কী খবর হে? ফারাও জানতে চাইলেন।
ভয় হচ্ছে, মহান ফারাও, কোনো কাজ না পেলে আমার বাহিনী ঘুমিয়ে পড়তে পারে।
তবে চলো, তোমার বাহিনীর গান শোনা যাক এবারে।
এবারে, আক্রমণে নেমে পড়লো শিলুক পদাতিক বাহিনী। বিউন-এর পদাতিক বাহিনীর সাথে মুখোমুখি লড়াই হলো তাদের। পিছনে থেকে রথ বহর নিয়ে সাহায্যে থাকলাম আমরা।
সবার মাঝখানে থেকে বীরের মতো লড়লো ক্ৰাতাস। গোলমালের ভেতর কখনো কখনো হারিয়ে ফেলছিলাম তাকে, ভয় হচ্ছিলো, হয়তো আর দেখতে পাবো না, কিন্তু তখনি তার অসট্রিচের পালকখচিত শিরস্ত্রাণ গর্বিত ভঙ্গিতে নিজের অবস্থানের কথা জানান দিলো ।
কেন্দ্রে যেখানে লড়ছিলো ক্ৰাতাস, প্রথমে সেখান থেকেই পরাজয় মেনে পিছু হটতে লাগলো হিকসস্ পদাতিক বিভাগ। শক্তিশালী শত্রু বাঁধে সেই ছিলো প্রথম ফাটল। প্রচণ্ড চাপের মুখে পিছনে, নিজেদের সৈন্যদের উপরই জেঁকে বসলো হিকসস্ পদাতিক।
হোরাসের কৃপায়, আর সমস্ত দেবতার ইচ্ছেয়, শেষপর্যন্ত বিজয়ী হতে চলেছি আমরা, টাটা। আমার আগেই মেমনন টের পেলো বিজয়ের ক্ষণ।
ঘোড়া দাবড়িয়ে, রেমরেম-এর প্রথম রথ বহরের কাছে ফিরে চললাম আমরা। তখনো অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে সে।
তুমি তৈরি, সেনাপতি রেমরেম?
সেই সূর্যোদয় থেকে, মহান ফারাও।
শত্রু বুহ্যে ফাটল ধরেছে, পিছু হটছে তারা। যাও, তোমার রথ বহর নিয়ে তাদের মেমফিস পর্যন্ত তাড়িয়ে দিয়ে এসো!
আপনি চিরজীবী হোন, ফারাও! চেঁচিয়ে উঠে, রথের পাদানীতে চড়ে বসে রেমরেম। লড়াইয়ের তৃষ্ণায় অধীর তার বাহিনী, ঘোড়াগুলো একদম তাজা ।
হিকসস্দের ডান কোণা দিয়ে ভেঙেচুড়ে ঢুকে গেলো তারা। মুহূর্তের মধ্যে ছত্র ভঙ্গ হয়ে গেলো হিকসস্ পদাতিক। ধসে পড়লো সমস্ত প্রতিরোধ। একজন সৈন্যকেও জীবিত ছাড়েনি শিলুক। এ লড়াই ছিলো ফারাও টামোসের অসাধারণ সমরকৌশলের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শেষ মুহূর্তের মারণ-আঘাতের জন্যে নিজের সেরা যোদ্ধাদের সংরক্ষণ করে রেখেছিলো সে। অনায়াস পেশাদারিত্বের সঙ্গে, সংখ্যায় কম হয়েও শেষমুহূর্তে বিজয় ছিনিয়ে আনলো রেমরেম-এর প্রথম রথ বহর।
সত্যিই, রাত নামার আগ পর্যন্ত পলায়নরত হিকসস্ সেনাদের তাড়িয়ে নিয়ে চললো রেমরেম। ত্রিশ মাইল দূর পর্যন্ত তাদের ভাগিয়ে দিয়ে এসেছিলো সে, যদি ঘোড়া ক্লান্ত না হয়ে পড়তো, তবে হয়তো মেমফিস পর্যন্তই চলে যেতোকে বলতে পারে?
*
শহরের প্রধান ফটক পর্যন্ত ফারাও-এর সোনালি রথ চালিয়ে নিয়ে গেলাম আমি। পাদানীতে পিঠ খাড়া রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি, ফটকের প্রহরীদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠলেন, দরোজা খোলো! যেতে দাও আমাদের!
কে প্রবেশ করতে চায় থিবেস নগরীতে? পাল্টা জানতে চায় তারা।
আমি টামোস–দুই রাজ্যের শাসনকর্তা।
জয় হোক ফারাও-এর! আপনি চিরজীবী হোন!
খুলে যায় প্রবেশদ্বার। আমার কাঁধে হাত ছোঁয়ালো মেম। ভিতরে নিয়ে চলো আমাকে, টাটা।
তার দিকে ফিরলাম আমি। ক্ষমা করুন, ফারাও। আমি শপথ করেছি, আমার কর্ত্রী, রাণী লসট্রিসের সঙ্গেই প্রবেশ করবো এই শহরে। বাকি পথটুকু আপনি নিজে চালিয়ে যান।
ঠিক আছে, নির্দেশ ধ্বনিত হলো ফারাও-এর কণ্ঠে। যাও, তোমার মিসট্রেসকে নিয়ে এসো।
তার হাতে ঘোড়ার লাগাম তুলে দিয়ে ধূলিময় পথে নেমে এলাম আমি। সোনালি রথ চালিয়ে প্রধান ফটক গলে শহরের ভেতরে প্রবেশ করলো মিশরের সম্রাট, উৎসাহের ধ্বনি শোনা গেলো শহরে।
ফারাও-এর পিছু পিছু প্রবেশ করছে যুদ্ধক্লান্ত সেনাবাহিনী। কী চরম মূল্য দিতে হয়েছে আমাদের এই লড়াইয়ে–তখন বুঝলাম। এই সেনাবাহিনীকে আবারো ঢেলে সাজিয়ে নিতে হবে হিকসস্দের সাথে লড়াইয়ের আগে। ততোদিনে সময় পেয়ে যাবেন রাজা স্যালিতিস, হলুদ–ফসের কবল থেকে মুক্তি পাবে তার ঘোড়ার পাল। একটি লড়াই হয়তো জিতেছি আমরা, কিন্তু আমি জানি, এই মিশর থেকে দখলদার বাহিনীকে তাড়িয়ে দেওয়ার আগে আরো অনেক যুদ্ধ লড়তে হবে আমাদের।
শিলুকরা হেঁটে ফিরছে শহরে। ক্রাতাসের খোঁজে এদিক-সেদিক তাকালাম আমি।