দুর্বল শত্রু সারিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা। ঝাঁকে ঝাঁকে রথ এগিয়ে গিয়ে ছিঁড়ে ফালাফালা করতে থাকে শত্রুর প্রতিরোধ। ওদিকে তাদের ডান কোণা তখনো আক্রমণে এগিয়ে চলেছে। কেন্দ্রের দিকে অবিন্যস্ত হয়ে পড়েছে হিকসস্ বাহিনী। তৃতীয় রথ বহর একত্র করে শত্রু বাহিনীর কেন্দ্রের দিকে লেলিয়ে দিলো এবারে মেমনন।
আক্রমণে যাওয়ার প্রাক্কালে শহরের উপরে চোখ বুলিয়ে নিলাম পিছনে তাকিয়ে। ধুলোর কারণে দৃষ্টি চলেনা, কিন্তু হোরাসের আঙুলের চূড়ায় সাদা পতাকা ঠিকই দেখতে পেলাম আমি।
ফারাও! চিৎকার করে পিছনে দেখলাম। দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে পূর্ণোদ্যমে ছুটে আসছে নতুন এক শত্রু রথ বহর, ঠিক যেনো কালো পিঁপড়ের দল।
আপাচান তার সংরক্ষিত বাহিনী পাঠিয়েছে শেষ রক্ষার জন্যে। মেমনন চিৎকার করে উঠে। আর এক মুহূর্ত! এরপর তাকে পেয়ে যাবো আমরা ভালো দেখিয়েছে, টাটা!
পদাতিক বাহিনীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম আমরা। আপাচানের রথ বহরের মোকাবেলা করতে ছুটলাম। ভাঙাচোরা রথ আর আহত-নিহত ঘোড়া এবং মানুষের জটলার উপর দিয়ে পরস্পরের দিকে ছুটলো দুই বাহিনী। কাছাকাছি এসে পড়তে, পাদানীর উপর দাঁড়িয়ে সামনে তাকালাম আমি। কিছু একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে শত্রু রথ বহরে। এরপরই বিষয়টা বুঝতে পারলাম।
ফারাও! চেঁচিয়ে উঠলাম। ঘোড়াগুলো দেখুন! অসুস্থ ওগুলো! আগুয়ান শত্রু রথের ঘোড়াগুলোর বুকে মাখামাখি হয়ে আঝে হলুদ পুজ, শ্লেষা। নাক-মুখ থেকে ঝরেছে ওগুলো। আমার দৃষ্টির সামনেই হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলো একটা ঘোড়া।
মিষ্টি আইসিস! ঠিক বলেছো তুমি! শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেছে তাদের ঘোড়া। সাথে সাথেই ইতিকর্তব্য বুঝে নিয়েছে মেমনন। একেবারে শেষমুহূর্তে সরাসরি সংঘর্ষ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলো সে।
ফুলের পাপড়ির মতোই আগুয়ান হিকসস্ বহরের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে তাদের ঘিরে ফেলতে লাগলাম আমরা। টেনে-হিঁচড়ে, রথের ধাক্কায় আরো চাপ প্রয়োগ করে সঙ্গে করে চলতে বাধ্য করলাম অসুস্থ ঘোড়ার পালকে। একের পর এক আছড়ে পড়তে লাগলো হাঁপাতে থাকা ঘোড়াগুলো । কতোগুলো স্রেফ দাঁড়িয়ে পড়ে মাথা ঝুলিয়ে মাটি আঁচড়াতে শুরু করলো। একটি তীরও খরচ করলাম না আমরা।
লর্ড আকের-এর রথ বহর এতোক্ষণে ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। বিশ্রাম ছাড়াই একটানা দুইটি লড়াই লড়েছে তারা। হুই-এর চতুর্থ বাহিনীর কাছে ওদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসলো মেমনন। রেমরেম-এর প্রথম বহরের পাশেই অপেক্ষায় আছে হুই।
ফারাও! প্রথম বহর তৈরি! দয়া করে অনুমতি দিন! হতাশায় কেঁদে ফেললো রেমরেম।
মেমনন এমনকি তার দিকে ভালো করে তাকালোও না। হুই-এর রথের কাছে ফারাও-এর রথ চালিয়ে নিয়ে গেলাম আমি। দ্রুত বদলে দেওয়া হলো আমাদের রথের ঘোড়াদুটো।
তুমি তৈরি, হুই? জানতে চায় মেম। ওদিকে লর্ড আকের-এর ঘর্মাক্ত রথ বহর আমাদের পাশ দিয়েই বিশ্রামে চলে যাচ্ছে।
মিশর এবং টামোসের নামে! হুঙ্কার দিয়ে উঠে হুই।
তবে, এগোও! সামনে। আক্রমণে যাও! হেসে নির্দেশ দেয়। লাফ দিয়ে আগে বাড়লো আমাদের নতুন ঘোড়া ছুটে চললো ফারাও-এর রথ।
আমাদের সামনে যুদ্ধের ময়দানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আপাচানের ছয় বিভাগ রথ বহর। অর্ধেক ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে; মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে ওগুলোর ঘোড়া। হলুদ ফাঁস রোগে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে। কিছু ঘোড়া আহত। তবে এখনো অনেকগুলো রথই পূর্ণ মাত্রায় সক্ষম।
মুখোমুখি তাদের সঙ্গে লড়তে ছুটলাম আমরা। ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা রথ, তার কাঠামো চকচকে তামার তৈরি। পাদানীতে দাঁড়ানো পুরুষ ভীষণ লম্বা, চালকের মাথার উপর উঁচু হয়ে আছে। হিকসস্ রাজ-পরিবারের স্বর্ণমণ্ডিত শিরস্ত্রাণ মাথায়; গাঢ় দাড়িতে রঙে-বেরঙের ফিতে বাতাসে প্রজাপতির পাখার মতোই উড়ছে ওগুলো।
আপাচান! মেমনন সরাসরি হুমকি জানায়, তুমি শেষ হয়ে গেছে।
তার কণ্ঠস্বর কানে গেছে আপাচানের। আমাদের সোনালি রথ চিনতে পেরেছে সে, ঘোড়া ঘুরিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে ধেয়ে এলো সে। আমার কাঁধে চাপড়ে দিলো মেম।
দাড়িমুখো বর্বরটার পাশে নিয়ে চলো আমাকে! এবারে সময় হয়েছে তলোয়ারের খেলা দেখানোর!
আমরা কাছাকাছি চলে আসতেই দুটো তীর ছুঁড়ে দেয় আপাচান । বৰ্ম আঁকড়ে ধরে মেম, মাথা নিচু রেখে তীর এড়িয়ে গেলাম আমি, একটুও নিয়ন্ত্রণ হারালাম না রথের।
আমার পিছনে গর্জে উঠে খাপ থেকে নীল কিংবদন্তির তরবারি বের করলো মিশরের সম্রাট।
ঘোড়া ঘুরিয়ে নিলাম, ডানে যাওয়ার ভান করে, হঠাৎ করে উল্টো দিকে মোড় নিলো রথ। চতুরতার সাথে হিকসস্ রথের পিছনে চলে এলাম। পাশাপাশি ছুটছে এখন দুটো রথ, আমারটা একটু পিছনে। এক হাত বাড়িয়ে দড়ি সমেত আংটা লটকে দিলাম হিকসস্ রথের পেছনের কাঠামোতে। এক যোগে ছুটছে এখন দুটি রথ-কিন্তু পিছনে থাকায় সামান্য সুবিধা ভোগ করছি আমি। কিছুতেই আর শক্র রথের চাকার ঘুরন্ত ফলা আমাদের নাগাল পাবে না।
ঘুরে, আমার উদ্দেশ্যে তলোয়ার চালালো আপাচান। ঝট করে মাথা নামিয়ে নিলাম, পিছন থেকে মেমনন বর্মে ঠেকিয়ে দিলো আঘাতটা। এবারে নীল তলোয়ার চালালো সে। বড়ো এক চলতা তামা খসে গেলো আপাচানের অস্ত্র থেকে। রাগে, অবিশ্বাসে হুঙ্কার দিয়ে উঠে সে; বর্ম হাতে কোনো রকমে ঠেকায় পরবর্তী আঘাত।