এমন শত্রুর সঙ্গে জিততে হলে দেবতাদের সমস্ত কৃপা প্রয়োজন হবে আমাদের, সামান্য ভাগ্য এদের বিরুদ্ধে কোনো কাজেই আসবে না। দিনের শেষ আলোয় একে একে জ্বলে উঠতে লাগলো হিকসস্ ক্যাম্পের আগুন-যেনো তারার মেলা বসেছে। এর যেনো কোনো শেষ নেই- দৃষ্টির সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত।
কাছাকাছি চলে আসতে গন্ধ পেলাম আমরা। ক্যাম্প ফেলা সেনাবাহিনীর গন্ধ একেবারেই স্বতন্ত্র। বিভিন্ন ব্রানের এক মিশ্রণ এটা-রান্না-বান্না, নতুন কাটা খড়, ঘোড়ার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ, উন্মুক্ত ময়দানে ত্যাগ করা মানুষের বিষ্ঠার, চামড়া এবং পিচ-এর, ঘোড়ার ঘাম আর কাঠের পাত্র রাখা মদের গন্ধ সব মিলেমিশে একাকার। হাজার হাজার মানুষ গায়ে গায়ে লেগে থাকা তাঁবুতে আস্তানা গেড়েছে এরা।
আরো এগিয়ে চললো আমাদের জাহাজ। দূর থেকে ভেসে আসতে লাগলো নানান শব্দ। ঘোড়ার হেষারব, ধাতুর অস্ত্রের ঝনঝনানি, প্রহরীদের চিৎকার, তর্ক-বিতর্ক, হাসি-ঠাট্টা, গানের শব্দ।
নেতৃত্বে থাকা গ্যালির অধিনায়কের সঙ্গে দাঁড়িয়ে পুব তীরে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলাম আমি। শহরের দেয়ালের বাইরে কাঠ-বণিকদের ঘাটে নিয়ে চলেছি আমাদের জাহাজগুলো। ওখান থেকে ঘোড়ার পাল নামানো সহজ হবে।
বন্দরের প্রবেশমুখ চিহ্নিত করলাম, দাঁড়ের টানে ধীরে ভেসে চললাম আমরা। ঠিক আমার স্মৃতির মতোই আছে জাহাজ-ঘাটা। কাছাকাছি এসে পড়তেই শশব্যস্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো বন্দরের কর্তৃপক্ষ কাগজ-পত্র পরীক্ষা করে দেখবে তারা।
তার সামনে ঝুঁকে সম্মান দেখালাম আমি। সম্মানিত প্রভু। দারুন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। বাতাসে উড়ে পানিতে পড়ে গেছে আমার কাগজ, সেথ-এর চাল কোনো সন্দেহ নেই!
রাগে ফেটে পড়লো লোকটা। কিন্তু স্বর্ণের একটা আংটি তার হাতে গুঁজে দিতেই হাসিমুখে বিদায় নিলো সে।
একজন রাখাল পাঠিয়ে ঘাটের মশালগুলো নিভিয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করলাম আমি। কোনো উৎসাহী চোখের সামনে ঘোড়ার পাল নামাতে চাই না। বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে প্রাণীগুলো, নাক-মুখ থেকে শ্লেষা ঝরছে। বাধ্য হয়ে ঘোড়াগুলোর মাথার চারপাশে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হলো। শেষমেষ, মাত্র একশ ঘোড়া পাওয়া গেলো যেগুলো হাঁটার ক্ষমতা রাখে।
ওয়াগন রাস্তা ধরে উঁচু জমিনের উদ্দেশ্যে চললাম আমরা। গুপ্তচরদের খবর অনুযায়ী, ওখানেই রয়েছে হিকসস্ ঘোড়ার মূল পাল। হিকসস্দের প্রথম রথবাহিনীর গুপ্তবাক্যও জানিয়েছে আমাদের চরেরা; সঙ্গে আসা মিশরীয় নাবিকেরা চিৎকার করে প্রহরীর প্রশ্নের প্রতুত্তর করলো।
শত্রু বাহিনীর অভ্যন্তরে ঘোড়ার পাল নিয়ে ঘুরে ফিরলাম আমরা। চলার উপরই একটি একটি করে ঘোড়া ছেড়ে দিতে শুরু করলাম শত্রু আস্তাবলে। বিশটি হিকসস্ রথবহরে একে একে ছাড়া হলো ঘোড়ার পাল। এতো সহজ-স্বাভাবিকভাবে ঘুরে ফিরলাম আমরা কেউ কোনো বাধা দিলো না। এমনকি, শত্রু রাখালদের সাথে ঠাট্টা তামাশায়ও মেতে উঠলো আমাদের নাবিকেরা।
পুব দিগন্তে যতক্ষণে দিনের প্রথম রশ্মি ফুটে উঠতে শুরু করেছে, কাঠ-বণিকদের জাহাজ-ঘাটে ফিরে এসেছি আমরা ততক্ষণে। একটি মাত্র গ্যালি আমাদের অপেক্ষায় আছে। অসুস্থ ঘোড়ার পাল নামিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে ফিরে গেছে বাকি নৌবহর।
জাহাজে চড়ে বসলাম আমরা। হুই আর রাখালেরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো বিছানায়। তরুণ সূর্যালোকে প্রিয় থিবেসকে যতোক্ষণ দেখা গেলো, জাহাজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি।
দশদিন পর, গজ-দ্বীপের বন্দরে নোঙর করলাম আমরা। ফারাও টামিেসকে অভিযানের খবর জানিয়েই ছুটলাম হারেমে। বারাজ্জার ছাউনির নিচে শুয়ে ছিলো আমার কর্ত্রী। এতো ফ্যাকাসে, এতো রুগ্ন দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো আমার। আমাকে দেখতে পেয়ে কেঁদে ফেললো লসট্রিস।
তোমাকে অনেক মনে পড়েছে, টাইটা। আর মাত্র অল্প সময় একসাথে থাকতে পিরবো দু জন।
*
নীল নদের পানি নেমে গেছে। বন্যা প্লাবিত জমিন আবার দেখা দিলো পানির নিচ থেকে। গাঢ়, ঘন পলি পড়ে আছে ওগুলোর উপর। ধীরে ধীরে শুকিয়ে আসলো এক সময়ের জলমগ্ন রাস্তা–উত্তরের যোগাযোগ আবারো শুরু হলো। অল্প দিনের মধ্যেই বীজ বপনের সময় এসে যাবে, এসে যাবে যুদ্ধের সময়ও।
আতন এবং আমি উদ্বিগ্ন মনে উত্তরের বিভিন্ন গুপ্তচরের খবরাখবর শুনতে লাগলাম। আমাদের আকাঙ্ক্ষিত সংবাদ এলো অবশেষে, যার জন্যে এতো প্রার্থনা আর অপেক্ষা। উত্তরে বাতাসে প্রায় উড়ে আসা একটা ফেলুচা সেই সংবাদ বয়ে নিয়ে এলো। রাতের তৃতীয় প্রহরে পৌঁছুলো বার্তাবাহক-তখনো প্রদীপ জ্বালিয়ে কাজ করছিলাম আমি এবং আতন।
ময়লা প্যাপিরাসের টুকরোটা রাজকক্ষে নিয়ে চললাম আমি। যে কোনো সময়ে আমাকে প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়ার নির্দেশ দেওয়া আছে প্রহরীদের। কিন্তু রাণী মাসারা রাজার শয্যাকক্ষের প্রবেশদ্বারে আমার পথ আগলে দাঁড়ালো।
এখন ওকে জাগাতে দেবো না আমি, টাইটা। রাজা ক্লান্ত। পুরো মাসের মধ্যে কেবল আজ রাতেই একটু ঘুমোতে পেরেছে ও।
মহারাণী, আমাকে তার সাথে দেখা করতেই হবে। সরাসরি তারই নির্দেশে
যখন তর্ক করছিলাম আমরা, ভারী একটা তরুণ কণ্ঠস্বর পর্দার ওপাশ থেকে সাড়া দেয়। কে ওটা, টাটা নাকি? একপাশে সরে গেলো পর্দা। নগ্ন দেহে সামনে এসে দাঁড়ালেন রাজা। তার মতো সুঠাম দেহের পুরুষ আমি খুব কম দেখেছি শক্ত, হালকা-পাতলা, নীল সেই তলোয়ারের মতোই ধারালো; পৌরুষের আভিজাত্য শরীরে। নিজের অপ্রাপ্ততা নিয়ে আরো একবার কুণ্ঠিত হয়েছিলাম সে রাতে।