কর্কশ হাসে ক্ৰাতাস। সেথ্-এর টাক মাথার কসম! টাইটা, হিকসস্দের বিরুদ্ধে তোমার ওই হাস্যকর প্রাণী নিয়ে লড়তে চাও নাকি? বিনীতভঙ্গিতে তার কথার প্রত্যুত্তরে হাসলাম আমিও। তার অধীন জংলী শিলুকদের মতো ক্রাতাসের রসবোধও অত্যন্ত বাজে।
পরদিন সকালে আমি এবং হুই নদী ছেড়ে চললাম ন্যূ-এর পাল ফিরিয়ে আনতে। তততদিনে কেবল তিনশো প্রাণী রয়েছে আমাদের খোঁয়ারে, একদম পোৰা ঘোড়ার মতো আমাদের হাত থেকে খায় এখন ওরা। ধীরে, ওগুলোকে একত্র করে রওনা হলাম আমরা।
শুধু রেমরেম-এর উদ্ধার করা ঘোড়াগুলোকে আমার নির্দেশে আলাদা রাখা হয়েছিলো আমাদের ঘোড়াগুলো থেকে–কুশ দেশ থেকে যেগুলো নিয়ে এসেছিলাম আমরা। হুই এবং আমি একই আস্তাবলে ওগুলোর সাথেই রাখলাম ন্যূ-এর পাল। প্রথম কয়েক মুহূর্তের অস্বস্তি শেষে একসাথে মিশে গেলো দুই ভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। রাতে একই খোয়ারে রাখলাম নূ্য এবং হিকসস্দের থেকে উদ্ধার করা ঘোড়াগুলো। হুইকে প্রহরায় রেখে, গজ-দ্বীপে রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলাম আমি।
এখন স্বীকার করি, সেই দিনগুলো চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটিয়েছিলাম। প্রাকৃতিক সেই মহামারীর উপর সমস্ত কিছু বাজী ধরেছিলাম, যা ছিলো মূলত এমন এক ঘটনা যার সবটুকু আমার কাছে পরিষ্কার ছিলো না। যদি এটা ব্যর্থ হয়, সংখ্যায় অনেক বেশি শত্রুর বাহিনীর মুখোমুখি হতে হবে আমাদের।
প্রাসাদের গ্রন্থাগারে আতনের সাথে স্ক্রোল নিয়ে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এমন সময় কর্কশ এক জোড়া হাতের ধাক্কায় জেগে উঠলাম। চিৎকার করছিলো হুই, উঠো, বুড়ো গর্দভ! উঠো! খবর আছে আমার কাছে!
নিচের মাঠে ঘোড়া নিয়ে এসেছে সে। নদী পেরুতেই, উধ্বশ্বাসে ঘোড়া দাবড়ালাম দু জন। চাঁদের আলোয় নদীর তীর ধরে আমাদের ঘোড়ার পালের কাছে ফিরে চললাম। আলো জ্বালিয়ে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছে রাখালেরা।
সাতটি হিকসস্ ঘোড়া ইতিমধ্যেই শায়িত অবস্থায় আছে, নাক-মুখ দিয়ে হলুদ পুঁজ বেরিয়ে আসছে সেগুলোর। দম বন্ধ করে মরার আগেই তাদের শ্বাসনালী কেটে প্যাপিরাসের নলখাগড়া ঢুকিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার বন্দোবস্ত করছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাখালেরা।
কাজ হয়েছে! উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে, আমাকে ঘিরে এক পাক নেচে নিলো হুই। হলুদ-ফাঁস! কাজ হয়েছে ওটায়! কাজ হয়েছে।
আমি তো ভেবেছিলাম ওটা, তাই না? গম্ভীরভাবে তার উদ্দেশ্যে বললাম আমি। অবশ্যই কাজ হয়েছে এতে।
আজকের দিনটির জন্যেই নদীর ধারে নোঙর করে ফেলে রাখা হয়েছে জাহাজগুলো। ওগুলোতে চড়ে দাঁড় টেনে উত্তরে রওনা হলাম আমরা। পঞ্চাশজন দাড়ীর প্রাণান্ত পরিশ্রমে, এবং পিছনে অনুকূল বাতাস পেয়ে তরতর করে থিবেস-এর উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললো গ্যালি। আপাচানের জন্যে মূল্যবান উপহার নিয়ে যাচ্ছি আমরা।
*
কম-ওম্বোতে পৌঁছুনোর সাথে সাথে নীল পতাকা নামিয়ে নিলাম আমরা। হিকসস্দের পতাকা উত্তোলন করা হলো জাহাজের মাস্ট হেডে। গ্যালির বেশিরভাগ নাবিকই ছিলো হিকসস্ শাসনের বন্দী। এদের মধ্যে কেউ কেউ এমনকি অনর্গল বিদেশী বর্বরদের
ভাষায় কথাও বলতে পারে। কম-ওম্বো থেকে দুই রাত পর, একটি হিকসস্ গ্যালি তেড়ে এলো আমাদের জাহাজ দেখতে পেয়ে। পাশেই থেমে, পরীক্ষা করে দেখার জন্যে একটা দল পাঠালো তারা আমাদের নৌযানে।
প্রভু আপাচানের রথের জন্যে ঘোড়া নিয়ে এসেছি, আমাদের অধিনায়ক জানালো তাদের। তার বাবা ছিলো হিকসস্ কিন্তু মা সম্ভ্রান্ত মিশরীয় মহিলা। খুবই আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে কথা বলে গেলো সে। দায়সারা গোছের পর্যবেক্ষণ শেষে আমাদের যেতে দিলো হিকসস্ গ্যালি। থিবেস-এ পৌঁছানোর আগে আরো দুইবার তল্লাশির সম্মুখীন হয়েছিলাম আমরা। প্রতিবারই আমাদের অধিনায়ক বোকা বানাতে সক্ষম হলো হিকসস্ নেতাদের ।
ততক্ষণে আমার একমাত্র দুশ্চিন্তা ঘোড়াগুলোর অবস্থা নিয়ে। আমাদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, মারা যাচ্ছে ওগুলো। অর্ধেক প্রাণী অবশ্য বেঁচে আছে করুণ হালে। লাশ পানিতে ফেলে এগিয়ে চললাম আমরা।
আমার প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিলো থিবেস বন্দরে নিয়ে ঘোড়াগুলোকে বিক্রি করে দেয়া। কিন্তু এমন অবস্থায় কেউ ঘোড়া কিনতে সম্মত হবে না। কাজেই, অন্য চিন্তা করলাম হুই এবং আমি।
ঠিক সূর্যাস্তের সময় থিবেস-এ পৌঁছুনোর বন্দোবস্ত করা হলো। পরিচিত স্থাপনা দেখতে পেয়ে কেমন যেনো করে উঠলো বুকের ভেতরটা। মন্দিরের দেয়াল দিনের শেষ সূর্যরশিতে চমকাচ্ছে। ইনটেফের জন্যে আমার তৈরি করা তিনটি খাম্বা এখনো আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। হোরাসের আঙুল বলা হয় ওই তিনটিকে।
পশ্চিম তীরে রয়েছে মেমননের প্রাসাদ, অর্ধ-সমাপ্ত রেখে গিয়েছিলাম ওটা; হিকসসেরা নিজেদের মতো করে নির্মাণকাজ শেষ করেছে। এমনকি আমি পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হলাম, এশীয় ধাচের নির্মাণশৈলী চমৎকার। ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু আলোয় পেঁচানো সিঁড়িকোঠা, প্রহরী-পিঠ কেমন রহস্যময় আভিজাত্য এনে দিয়েছে প্রাসাদের ভবনে। যদি মিসট্রেস এই মুহূর্তে উপস্থিত থাকতো ভেবে আফসোস হলো। বহুদিন ধরে এখানে আসার জন্যে প্রাণ আনচান করছে তার।
শহরের দেয়ালের বাইরে বিশাল ঘোড়ার পাল, রথ আর লোকজনের উপস্থিতি চোখে পড়লো। যদিও আগে থেকেই জেনে গেছিলাম, আপচান তার বাহিনী নিয়ে অপেক্ষায় আছে সেখানে, নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না, সংখ্যায় এতো বেশি পরিমাণে তারা । আমার ভেতরটা যেনো দমে গেলো।