আমার দেহের উপর ভর দিয়ে বহু কষ্টে পালকি থেকে নামলো লসট্রিস। ধীরে এগিয়ে ঢুকরো শান্ত বাতাসের সেই মন্দিরে।
একসঙ্গে প্রার্থনায় বসেছিলাম আমরা দু জন । আমি জানি, এই পৃথিবীতে যে দু টি প্রাণ তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো, তাদের প্রার্থনা সেদিন শুনেছিলো ট্যানাস। যাওয়ার আগে, সঙ্গের সমস্ত স্বর্ণ মন্দিরের পুরোহিতদের উদ্দেশ্যে দান করে গেলো আমার কর্ত্রী।
গজ-দ্বীপে, আমাদের প্রাসাদে যতক্ষণে পৌঁছুলাম, অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ও। প্রতিদিন তার পেটের ভেতরের সেই বস্তু বেড়ে চলেছে আকৃতিতে, শুষে নিচ্ছে ওর জীবনসূধা। জলবাগানে, বারজ্জায় একটা তাকিয়া টেনে ওকে বসতে দিলাম আমি। চোখ বন্ধ করে কিছুসময় নিঃসারে পড়ে রইলো মিসট্রেস। এরপর, চোখ খুলে নরম করে হাসলো আমার উদ্দেশ্যে। এখানে এক সময় কতো সুখের সময় কাটিয়েছি। আমরা, তাই না টাইটা? মৃত্যুর আগে কি আর থিবেস নগরীকে দেখতে পাবো না আমি? এর উত্তর নেই আমার কাছে। এমন কোনো প্রতিজ্ঞা কেমন করে করবো, যা আমার সাধ্যের ভেতর নেই।
যদি আগেই মারা যাই, প্রতিজ্ঞা করো, আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে পাহাড়ের উপরে কবর দেবে; যেনো উপর থেকে প্রিয়তম থিবেসকে সব সময় দেখতে পাই?
আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে এই শপথ করলাম তোমাকে, আমি বললাম উত্তরে।
*
পরবর্তী দিনগুলোতে আতন এবং আমি, আমাদের পুরোনো গুপ্তচরদের দলকে আরো সংগঠিত করতে লাগলাম উচ্চ-রাজ্যে। ফারাও মামোসের শাসনামলে যারা আমাদের হয়ে কাজ করেছে, তাদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। কিন্তু অনেকে আবার টিকেও আছে। স্বর্ণের লোভে, না হয় দেশপ্রেমের কারণে প্রতিটি শহর আর গ্রামে আমাদের হয়ে কাজ করলো অনেক তরুণ ছেলেরাও।
দ্রুতই, থিবেস-এ শত্রুর ঘাটিতে গুপ্তচর পেয়ে গেলাম আমরা। নিম্ন-রাজ্যের ডেল্টা থেকেও খবরাখবর আসতে লাগলো। তাদের কাছ থেকে পাওয়া সংবাদে জানা গেলো, বিভিন্ন শহর থেকে একত্র হচ্ছে হিকসস্ বাহিনী, একসঙ্গে এগিয়ে আসছে তারা। তাদের শক্তিমত্তা, দুর্বলতা, প্রতিটি বাহিনীর নেতাদের নাম জানা হয়ে গেলো আমাদের। আরো জানতে পারলাম, ঠিক কতোটি জাহাজ বা রথ রয়েছে হিকসস্ শিবিরে; নীল নদে বন্যার পানি কমে আসতে বিশাল সেই সেনাবাহিনী আর জাহাজ, রথ নিয়ে দক্ষিণে রওনা হওয়ার পরিকল্পনা করছে রাজা স্যালিতিস।
ফারাও টামোসের নামে বিভিন্ন বার্তা গোপনে হিকসস্ বাহিনীর মিশরীয় সৈনিকদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম আমি। আরো গুরুত্বপূর্ণ খবর আসতে লাগলো চারিদিক থেকে। কিছুদিনের মধ্যেই হিকসস্ বাহিনী থেকে একজন দু জন করে আমাদের দলে যোগ দিতে শুরু করলো মিশরীয় দেশপ্রেমিক সেনারা। সশস্ত্র অবস্থায় পুরো দুই বাহিনী তীরন্দাজ, নীল পতাকা হাতে যোগ দিলো আমাদের সাথে। তাদের কণ্ঠে ছিলো একই চিৎকার, টামোস! মিশর!
একশ হিকসস্ যুদ্ধ গ্যালির নাবিকেরা বিদ্রোহ শুরু করলো। নদীর উজানে, আমাদের সাথে যখন যোগ দিলো তারা, থিবেস বন্দর থেকে দখল করা বেশ কিছু নৌযান ছিলো তাদের সাথে । খাদ্য-শস্য, তেল, লবণ আর গাছের গুঁড়িতে বোঝাই ছিলো প্রতিটি শত্রু জাহাজ।
ততোদিনে জলপ্রপাতের নিচে নেমে এসেছে আমাদের পুরো বাহিনী। কেবল পোষ মানানো নৃ-দের ছোট্ট পাল ছাড়া। একেবারে শেষমুহূর্তের জন্যে ওগুলোকে রেখে দিয়েছি আমি। উত্তর খাম্বায় আমার অবস্থান থেকে নদীর দুই তীরে যেদিক চোখ গেলো, মাইলের পর মাইল ঘোড়ার সারি দেখা যায়। ক্যাম্পের ধোয়া আকাশে এঁকে বেঁকে উড়ে যাচ্ছে।
প্রতিটি দিনই ক্ষমতা বাড়ছিলো আমাদের। সমগ্র মিশরে যেনো উত্তেজনা আর প্রত্যাশার সুবাতাস বইছে। চারিদিকে স্বাধীনতার সুবাস। নতুন জাগরণ ঘটছে আমাদের এই কেমিট-এ। রাস্তায় রাস্তায়, গলি-উপগলিতে, ছাপড়ায়, পতিতাপল্লিতে, সুরার দোকানে শুধু স্বাধীনতার গান।
আতন আর আমি বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে থাকা সংবাদ এক করে ভিন্ন ছবি পেলাম। হিকসস্ দৈত্য নিজের গা ঝাড়া দিয়েছে এবারে, থাবা বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে। মেমফিস, এবং ডেল্টার সমস্ত শহর থেকে এগুতে শুরু করেছে স্যালিতিসের পদাতিক বাহিনী। প্রতিটি পথ তার রথে বোঝাই, নদীর পানিতে গিজগিজ করছে তার জাহাজ বহর। দক্ষিণে, থিবেস-এর পথে রয়েছে তারা।
আপাচান হিকসস্ বাহিনীর রথবহরের অধিনায়ক নিজে সমরাঙ্গণে না পৌঁছা পর্যন্ত অপেক্ষায় রইলাম আমি। থিবস-এ, শহরের দেয়ালের বাইরে তার ঘোড়া এবং রথ সমেত ক্যাম্প করবার সংবাদ পাওয়ার পর মিশরের সম্রাটের যুদ্ধ সভায় উপস্থিত হলাম।
সম্মানিত ফারাও, আমি জানতে পেরেছি এই মুহূর্তে শত্ৰু বহরে একশ বিশ হাজার ঘোড়া এবং বারো হাজার রথ রয়েছে। থিবেস-এ ঘাঁটি গেড়েছে তারা। আগামী দুই মাসের মধ্যে বন্যার পানি সরে গিয়ে তাদের আক্রমণের পথ উন্মুক্ত করে দেবে।
এমনকি, ক্ৰাতাসকে পর্যন্ত চিন্তিত দেখালো। এর চেয়েও খারাপ অবস্থায় লড়েছি–শুরু করেছিলো সে, কিন্তু রাজা থামিয়ে দিলেন তাকে।
ওর চেহারা দেখে বুঝতে পারছি, রাজকীয় আস্তাবলের পরিচালকের আরো কিছু বলার আছে। তাই না, টাইটা?
ফারাও সবসময় সঠিক, আমি একমত হলাম। জলপ্রপাতের ওপার থেকে আমার ন্যূ-এর পাল নিয়ে আসার অনুমতি চাইছি আপনার কাছে।