তিনটি দ্বীপ নদীর স্রোতধারাকে বিভক্ত করে ফেলেছে সামনে।
বামে থাকো! নীল পতাকার দিকে চাকা ঘোরাও। চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। এমন সময় পায়ের নিচে কেঁপে উঠলো পাটাতন, আঁকড়ে ধরে সামলে নিলাম আমি।
বনবন ঘুরছে আমাদের গলুই। ইতিমধ্যেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাথুরে দ্বীপের সঙ্গে সংঘর্ষে গুড়ো গুড়ো হতে যাচ্ছি আমরা আমি নিশ্চিত। এরপরই ধীরে সোজা হতে লাগলো গলুই।
ক্রাতাসের কর্কশ ভাষার নির্দেশে প্রাণপণ দাঁড় টেনে কোনোক্রমে সংঘর্ষ এড়ানো গেলো। আর একটা মাত্র বাঁক ঘুরলেই খাড়া পতন। পেটের ভেতরে শূণ্য অনুভূতি জলপ্রপাতের ধার থেকে নিচে খসে পড়লো আমাদের গ্যালি। নিচে পরে ভীষণ জলস্রোতে দিক হারিয়ে ঘুরতে শুরু করলো।
বামে টানা! চিৎকার করে বললো ক্ৰাতাস, দাড়ীদের উদ্দেশ্যে। প্রাণপণে টানো! জাহাজ স্থির হয়ে কোনোরকমে এগিয়ে গেলো পরের বাকের কাছে।
একবার মাত্র আমাদের খোল ঘষা গেলো নিচের পাথরে, পায়ের নিচে কেঁপে উঠলো পাটাতন। ভয়ে চিৎকার করতে পর্যন্ত ভুলে গেছিলাম। গলুইয়ে দাঁড়ানো নাবিকের দল রক্ষা করলো সে যাত্রা।
পিছনের প্রচণ্ড শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম, ধসে গেছে একটি গ্যালি। সাহস হলো তাকিয়ে দেখার, ওদিকে পরবর্তী বাকের কাছে চলে এসেছি আমরা। চারপাশের পানিতে ধ্বংসপ্রপাত গ্যালির ভাঙ্গা অংশ আর কালো কালো মাথা দেখা গেলো; ভীষণ স্রোতে পরে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিছু করার নেই ওদের জন্যে। নিজেদের প্রাণ নিয়ে ছুটছি আমরা ।
সেই ঘন্টায়, কত শতোবার যে মরলাম আর বাঁচলাম–গুনে শেষ করা যাবে না। অবশেষে, জলপ্রপাতের তলা থেকে শান্ত নদীতে পৌঁছুলো আমাদের গ্যালি।
উল্লাস করার ফুরসত নেই; সামনেই চিরপরিচিত গজ-দ্বীপ, নদীর দুই তীরে অনেক আপন সব স্থাপনা।
তীরন্দাজেরা! ধনুক হাতে তুলে নাও! রাজা টামোস হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন গলুইয়ে দাঁড়িয়ে। নীল পতাকা উত্তোলন করা হোক! ঢাক বাদকেরা আমার, আক্রমণের ছন্দ বাজাও!
গজ-দ্বীপের পথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাক জাহাজ বহরের উদ্দেশ্যে ছুটে চললো আমাদের ছোট্ট বাহিনী। বেশিরভাগই বাণিজ্যিক, অথবা পরিবহন জাহাজ। এগুলো পেরিয়ে হিকসস্ গ্যালির উদ্দেশ্যে ধেয়ে গেলাম আমরা। মিশরীয় নাবিকদের দিয়ে নিজেদের গ্যালি সজ্জিত করেছে তারা, নদী সম্পর্কে যাদের জ্ঞান অসীম। কেবলমাত্র নৌ-অধিনায়কেরা হিকসস্, তাও এই মুহূর্তে তীরে আছে তারা। প্রাসাদে, প্রমোদপল্লিতে আরামরত।
গুপ্তচরদের মাধ্যমে আমরা জেনে গেছি, নৌবাহিনীর নেতার জাহাজ কোনটি। নিমিষে ওটার কাছে ভিড়ে বিশজন যোদ্ধা সহ লাফিয়ে চড়ে বসলো মেমনন।
হিকসস্ বর্বরদের থেকে মুক্তি! হুঙ্কার দিতে দিতে চললো তারা। আমাদের এই মিশরের পক্ষে এসো!
অবাক বিস্ময়ে তাদের দিকে চেয়ে থাকে মিশরীয় নাবিকেরা। একেবারে হকচকিয়ে গেছে তারা, বেশিরভাগের কাছেই কোনো অস্ত্র নেই। হিকসস্ অধিনায়কেরা এদের বিশ্বাস করতো না, কাজেই সমস্ত অস্ত্র জাহাজের নিচে তালাবদ্ধ প্রকোষ্ঠে আছে।
আমাদের বাহিনীর প্রতিটি গ্যালি একটি করে শত্রু জাহাজ দখল করে নিতে শুরু করেছে। প্রতিটি জাহাজের নাবিকদের প্রতিক্রিয়া হলো অভিন্ন। প্রথম বিস্ময়ের থাকা সামলে তারা প্রশ্ন করলো, কারা তোমরা?
উত্তর দিলো হাজারো কণ্ঠ। মিশরীয়! সত্যিকারের ফারাও টামোসের লোক আমরা। আমাদের সাথে এসো, হে দেশবাসী! বর্বরদের উৎখাত করি চলো?
হিকসস্ নেতাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো তারা। আমরা কিছু করার আগেই নিকেশ হয়ে গেলো সব ক টা।
মাতৃভূমির জন্যে! গর্জন করে উঠলো মিশরীয় নাবিকের দল। টামোসের জন্যে। মিশর আর টামোসের জয় হোক!
এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে বয়ে যেতে লাগলো সেই সুর। হিকসস্ পতাকা ছিঁড়ে ফেলে খুশিতে পাগলের মতো লাফাতে লাগলো আমাদের লোকেরা। অস্ত্রশালা খুলে, জাহাজের নিচ থেকে ধনুক আর তলোয়ার বিতরণ শুরু হলো।
এরপর, তীরে নেমে গেলো তারা। টেনে-হিঁচড়ে হিকসস্ যোদ্ধাদের বের করে এনে রক্তাক্ত লাশে পরিণত করতে লাগলো মিশরীয় জনতা। বন্দরের পানি লাল হয়ে গেলো রক্তে। রাজ্যের পথে পথে যতো সেনাসদর আছে, তার সবগুলোতে একে একে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো ঐক্যবদ্ধ মিশরীয় বীরেরা।
মিশর আর টামোসের জন্যে! তাদের কণ্ঠে ছিলো একই চিৎকার।
কোনো কোনো স্থানে জড়ো হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইলো হিকসস্ নেতারা। তখন ক্ৰাতাস আর মেমনন অভিজ্ঞ যোদ্ধাদের নিয়ে নেমে এলো সমরাঙ্গনে। দুই ঘণ্টার মধ্যে শহর দখর করে নিলাম আমরা।
বেশিরভাগ হিকসস্ রথ পরিত্যক্ত পড়ে আছে রাস্তায়। তবে অর্ধেক বাহিনী ইতিমধ্যেই পুব প্রবেশদ্বার পেরিয়ে বন্যাপ্লাবিত নিচু জমিনের উপর দিয়ে ছুটছে।
জাহাজ ছেড়ে চিরপরিচিত গলি-উপগলি ধরে ছুটলাম আমি। উত্তর খাম্বায় চড়ে সবচেয়ে ভালো দেখতে পাবো চারিদিকের অবস্থা। তিক্তমনে লক্ষ্য করলাম, পালিয়ে যাচ্ছে হিকসস্ রথ। প্রতিটি পালিয়ে যাওয়া রথের অর্থ হলো, ভবিষ্যতে এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে লড়তে হবে আমাদের। আর তাছাড়া, ঘোড়াগুলো চাই আমার । হঠাই পশ্চিমের পাহাড়ের পাদদেশে থেকে ছোট্ট একটা ধুলোর ঘূর্ণি নজরে পড়লো।
চোখের উপরটা আড়াল করে সেদিকে তাকালাম। ভিতরে ভিতরে দানা বাঁধছে উত্তেজনা। দ্রুত কাছে চলে আসছে ধুলোর মেঘ এখন আকৃতিগুলো পরিচিত মনে হচ্ছে।