থিবেস-এর আগেই বন্যা উদ্রুত সমতলে সমস্ত শক্তি নিয়ে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে স্যালিতিস, কেবল পানি নেমে যাওয়ার অপেক্ষা। ততোদিনে আমরা শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারবো পথে পথে সৈন্য সগ্রহ করে।
গুপ্তচরদের থেকে জানা গেলো, সীমান্তে কোনো রকম আক্ৰমণ আশা করছে না তারা। কাজেই প্রথম চোটে বিস্ময়ের আঘাত দিতে সক্ষম হবো আমরা। জানা গেলো, মিশরীয় জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে রাজা স্যালিতিস। আমাদের প্রাসাদে থেকে, আমাদেরই দেব-দেবীর পূজো করে সে আজকাল। এমনকি, তাদের দেবতা সুখে পর্যন্ত সে-এ পর্যবসিত হয়েছে।
যদিও এখনো তার বাহিনীর সেনাপতিরা সবাই হিকসস্, কিন্তু অর্ধেক সৈনিক আমাদের দেশী। আমাদের নির্বাসনের সময় এরা নিশ্চই ছোট্ট বাচ্চা ছিলো। ভাবলাম, রাজকুমার মেমনন যখন মিশরের দখল ফিরে পেতে চাইবেন, এদের আনুগত্য কোন্ ভাগে পড়বে।
সবকিছু এখন তৈরি। প্রহরীরা মরুর ভেতর দিয়ে পশ্চিম তীর ধরে একটা পথ আবিষ্কার করেছে। সুপেয় পানি বহনকারী ওয়াগনগুলো যাত্রাপথে বিভিন্ন স্থানে মোতায়ান আছে, কাজেই আমাদের বাহিনীর লোকজনের মরু পেরুতে পানির অভাব হবে না। প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে গ্যালিবহরেরও। নীলে বান ডাকামাত্র রওনা হবো আমরা। কিন্তু ইত্যবসরে, একটি আচার সম্পন্ন করার আছে।
পাহাড় বেয়ে নদীর উপরে সেই স্থানে চলে এলাম, দুই দশক আগে যেখানে আমার কর্ত্রী তার স্মারকচিহ্ন রেখে গেছেন। মেঘমুক্ত নীল আফ্রিকার আকাশপানে এখনো গর্বোদ্ধত মস্তক খাড়া করে রেখেছে ওটা।
পাহাড় বেয়ে চলার শক্তি নেই লসট্রিসের দেহে। দশজন দাস কাঁধে করে বয়ে। চূড়ায় নিয়ে গেলো তাকে। রাজকুমার মেমননের হাতে ভর দিয়ে বহু কষ্টে হেঁটে সেই স্তম্ভের পাদদেশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। আমাদের পুরো জাতি, প্রতিটি চোখ চেয়ে রইলো তার দিকে।
জোরে জোরে খোদাই করা বাক্যগুলো পড়লো মিসট্রেস। ক্ষীণ হতে পারে, কিন্তু এখনো তার কণ্ঠস্বরে মধুর; মহৎপ্রাণ এবং সেনাপতিদের পিছনে থেকেও পরিষ্কার শুনতে পেলাম আমি।
আমি, রানি লসট্রিস, এই মিশরের শাসনকর্ত্রী এবং ফারাও মামোসের বিধবা পত্নী, যিনি ছিলেন ওই নামধারী অষ্টম ফারাও; আমার পরে যে এই দুই রাজ্য শাসন করবে–সেই রাজকুমার মেমননের মাতা, এই স্তম্ভ তৈরির নির্দেশ দিয়েছি…
পড়া শেষ হতে, জনতার দিকে ফিরে দুই হাত প্রসারিত করলেন রানি।
আমি আমার প্রতিজ্ঞা রেখেছি। তোমাদের নেতৃত্ব দিয়ে দেশের সীমান্তে পৌঁছে। দিয়েছি। আমার কাজ আজ শেষ হলো। একটুক্ষণের জন্যে বিরতি দিলো ও। আমার চোখে চোখ পড়তেই, মাথা নেড়ে উৎসাহ দিলাম। বলে চললো সে।
হে মিশরের অধিবাসী! সত্যিই, এই মূহুর্তে একজন সত্যিকারের ফারাও প্রয়োজন তোমাদের, যে নেতৃত্ব দিয়ে নিজ-বাসভূমে পৌঁছে দিবেন। আমি তোমাদের উদ্দেশ্যে পবিত্র ফারাও টামোসকে নেতৃত্বভার অর্পণ করলাম–যে স্বয়ং এই মিশরের রাজকুমার মেমনন। তিনি চিরজীবি হোন!
ফারাও চিরজীবি হোন! এক স্বরে চেঁচিয়ে উঠে পুরো জাতি। তিনি চিরজীবি হোন।
এক পা এগিয়ে নিজের জনগোষ্ঠীর সামনে দাঁড়ালেন ফারাও টামোস। খাপ থেকে কিংবদন্তির নীল তলোয়ার খুলে সালামের ভঙ্গিতে মেলে ধরলেন জনতার উদ্দেশ্যে।
পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনিত হলো তার কণ্ঠস্বর।
এই পবিত্র দায়িত্ব আমি মাথা পেতে নিলাম। আমার পুনরুজ্জীবনের নামে শপথ–আমার দেশ এবং তার অধিবাসীদের সেবায় জীবনের প্রতিটি দিন ব্যয় করবো। এই দায়িত্ব থেকে কখনো, কোনোমতেই পিছ পা হবো না–সমস্ত দেবতারা সাক্ষী।
*
বন্যা এসে গেলো। পানির স্তর উঁচু হয়ে জলপ্রপাতের প্রবেশমুখের পাথরশ্রেনী ঢেকে দিতে লাগরো। সবুজ থেকে ধূসরে পাল্টে গেলো পানির রঙ।
খাঁচায় বদ্ধ কোনো জানোয়ারের মতো ফুঁসে উঠলো জলপ্রপাত। তার ফেনা উপরের আকাশ আর চারিপাশ ঘিরে থাকা পাহাড় ছুঁতে চাইছে যেনো।
ক্রাতাস এবং ফারাও-এর সঙ্গে সামনের গ্যালিতে রইলাম আমি। নোঙর তুলে ফেলে জলস্রোতে ভেসে চললাম আমরা। প্রাণপণ মুঠিতে দাঁড় ধরে রাখলো যোদ্ধারা।
গলুইয়ে, রাজার পাশে থাকলো দুই দল নাবিক; সামনের পাথর খণ্ডে লগি দিয়ে ধাক্কা মেরে জাহাজের আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করবে তারা। পাটাতনের উপর জলপ্রপাতের মানচিত্র বিছিয়ে কাতাসের পাশে থাকলাম আমি, প্রতিটি বাঁকের আগে চিৎকার করে বলে দিচ্ছি। আসলে মানচিত্রের কোনো প্রয়োজন নেই আমার, সব মুখস্ত হয়ে গেছে। এছাড়াও, নদীপথের দ্বীপে বা তীরে আগেই পতাকা হাতে লোক মোতায়ান করে রেখেছিলাম, ওরা সতর্ক করে দিতে লাগলো।
খোলের নিচে দ্রুততর হলো স্রোতের বেগ, পিছনে এক নজর ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, পুরো বাহিনী এক সারিতে ভেসে চলেছে। আবার যখন সামনে তাকিয়ে দেখলাম, ভয়ে বুকের ভেতরটা যেনো খামচে ধরলো। ঠিক উনুনের মুখের মতো উন্মত্ত সামনের ঢালু প্রবেশ পথ।
প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চললো আমাদের গ্যালি। কেবল ভেসে থাকার জন্যে আলতো করে দাঁড় ছোঁয়াতে হচ্ছে পানিতে। এতো হালকাভাবে নদীর উপর দিয়ে ছুটে চলছিলাম, দাঁড় টানার কোনো প্রয়োজন নেই। তীরের কঙ্কালসার পাহাড় দ্রুত গতিতে পেরিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। ক্রাতাসের ঠোঁটের হাসি দেখে বুঝলাম, কঠিন বিপদ রয়েছে সামনে।