রাজপুত্র মেমনন এবং তার বাহিনীর সবাই ওখানে আমাদের অভিনন্দন জানানোর জন্যে অপেক্ষায় ছিলো। ইতিমধ্যেই, নতুন গ্যালিবহরের কাজ পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। এর একটির পাল আমাদের ধোকা দিয়েছিলো দূর থেকে। নিঃসন্দেহে কুশ দেশ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিলো সমস্ত কাঠ। সমস্ত রথ এখন তৈরি। মরুর উপর ঘোড়াগুলোকে দেখভাল করেছে হুই। নদীর তীরে খোয়াড়ে আছে ন্যূ-এর পাল।
মহিলা আর শিশুদের নিয়ে আরো ওয়াগন আসতে লাগলো আমাদের পিছনে। জাতির মূল অংশ ইতিমধ্যেই মরু পাড়ি দিয়ে চলে এসেছে। অবিশ্বাস্য এক কীর্তি ছিলো এটা, দেবতার সমতুল্য পরিশ্রমের প্রয়োজন ছিলো এ ধরনের একটি পরিকল্পনায়। কেবলমাত্র ক্রাতাস, রেমরেম এবং মেমননের মতো মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিলো এতো কম সময়ে এটা অর্জন করা।
এখন, আমাদের এবং আমাদের এই মিশরের মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেবল প্রথম জলপ্রপাত।
আবারো উত্তর অভিমুখে চললাম আমরা। তার এবং রাজকুমারীদের জন্যে প্রস্তুত করা রাজকীয় জলযানে চড়লো মিসট্রেস। বিশাল, খোলামেলা শয্যাকক্ষ তৈরি করা হয়েছে তার জন্যে। কারুকাজ করা ইথিওপিও উলের পর্দা ঝুলছে দেয়াল থেকে, কালো একাশিয়া কাঠের তৈরি আসবাব আইভরি আর কুশ দেশীয় স্বর্ণে নকশা করা। জাহাজের দেয়ালগুলো নানান রঙের পাখি আর ফুলের ছবি একে ভরে দিলাম আমি।
সব সময়ের মতো কর্ত্রীর বিছানার পায়ের কাছেই ঘুমোতাম আমি। পাল তোলার তিনদিন পর একদিন রাতে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। নিঃশব্দে কাঁদছিলো আমার রানি। বালিশে মুখ ঢেকে দমিয়ে রাখছিলো শব্দ, তবুও কাঁধের ঝাঁকুনিতে জেগে গেছিলাম আমি। ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে কোমল স্বরে শুধালাম, ব্যথা বেড়েছে?
তোমাকে জাগাতে চাই নি, টাইটা। আমার পেটে যেনো তলোয়ার সেঁধিয়ে গেছে।
ভীষণ শক্তিশালী ঘুমের গুঁড়ো দিলাম আমি ওকে। ধীরে ধীরে ওষুধের চেয়েও তীব্রতর হয়ে উঠছিলো ওর ব্যাথাটা।
মিশ্রণটা পান করে নিয়ে নীরবে শুয়ে থাকলো লসট্রিস। এরপর ও বললো, ওটা আমার পেট থেকে কেটে বের করে আনতে পারবে না তুমি, টাইটা?
না, মিসট্রেস, পারবো না।
তবে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখো না, টাইটা। ছোটোকালে যেমন করে জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়াতে।
ওর বিছানার কাছে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলাম লসট্রিসকে। আমার আলিঙ্গনে বাচ্চা মেয়ের মতোই রুগ্ন ঠেকলো তার দেহ। একটু একটু করে দোলা দিয়ে ধীরে ঘুম পাড়িয়ে দিতে লাগলাম ওকে।
*
গজদ্বীপে উপরে, প্রথম জলপ্রপাতের মাথার কাছে পৌঁছুলো নৌবহর। শান্ত নদীর জলধারায় তীরে নোঙর করলো জাহাজবহর।
সেনাবাহিনীর বাকি সদস্যদের আগমনের অপেক্ষাই রইলাম আমরা। কাতাসের নেতৃত্বে থাকা রথ বহর, শিলুক পদাতিক বাহিনী তখনো পৌঁছে নি। এছাড়া, বন্যার জলে নীল নদীর স্তর উঁচু না হওয়া পর্যন্ত জলপ্রপাত বেয়ে মিশরে নেমে যাওয়া সম্ভব নয়।
অপেক্ষার দিনগুলোতে নিচে গুপ্তচর পাঠিয়ে দিলাম আমরা। কৃষক, পুরোহিত অথবা বণিকের ছদ্মবেশে মিশরে পৌঁছে গেলো তারা। ক্রাতাসের সঙ্গে নিচের ফুঁসে উঠা জলরাশির আগ পর্যন্ত গিয়ে মানচিত্র এঁকে পথ বুঝিয়ে দিলাম আমি। পানি কম থাকায় ভয়ঙ্কর বিপদজনক নদীবক্ষ উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। ডুবো পাহাড়ের উচ্চতা সমান চিহ্ন দিয়ে রাখলাম আমরা তীরের মাটিতে, যাকে করে বন্যার সময়ও নিমজ্জিত বিপদ সম্পর্কে অবগত থাকতে পারি।
বহু সপ্তাহের পরিশ্রম শেষে নৌবাহিনীর কাছে ফিরে এলাম আমি। তততদিনে চলে এসেছে আমাদের পুরো সেনাবাহিনী। পাথুরে মরু এলাকার ভেতর দিয়ে রথ চলাচলের পথ খুঁজে দেখার জন্যে প্রহরী বাহিনী পাঠানো হলো। জলপ্রপাতের বিক্ষুব্ধ জলরাশির উপর দিয়ে রথ আর ঘোড়া পারাপারের উপায় নেই।
ওদিকে, গজ-দ্বীপ থেকে ফিরে আসতে লাগলো আমাদের গুপ্তচরেরা। একা একা, রাতের অন্ধকারে একজন দু জন করে এলো তারা। বহু বছর পর আমাদের মাতৃভূমির খবর পেলাম।
এখনো শাসন করছেন রাজা স্যালিতিস, তবে বুড়ো হয়ে গেছেন তিনি। হিকসস্ বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছে তার দুই ছেলে। রাজকুমার বিউন সেনাবাহিনীর দায়িত্বে আছে, আর রথ বহরের নেতৃত্বে রয়েছে রাজকুমার আপাচান।
আমাদের ধারণার চেয়েও বেশি হিকসস্ দের ক্ষমতার পরিধি। গুপ্তচরদের খবর মোতাবেক, বারো হাজার রথ আছে আপাচানের বাহিনীতে। অপরদিকে, আমরা কেবল চার হাজার রথ নিয়ে এসেছি। বিউনের কাছে আছে চল্লিশ হাজার পদাতিক এবং তীরন্দাজ সৈন্য। কাতাসের শিলুক বাহিনী সহ আমাদের পদাতিক বাহিনীর সংখ্যা পনেরো হাজারের বেশি নয়।
অবশ্য, ভালো খবরও আছে। হিকসস্দের বাহিনীর বেশিরভাগই এই মুহূর্তে ডেল্টায়, স্যালিতিস মেমফিস নগরীকে তার রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করছে। গজ দ্বীপে আর থিবেসে তাদের সরে আসতে বহু মাস সময় লাগবে। বন্যার পানি না নামা পর্যন্ত নদীর উজানে তার রথ বহর আনা সম্ভব হবে না। গজ-দ্বীপে এই মুহূর্তে মাত্র একশ রথবাহিনী পাহারায় আছে। ভারী চাকার পুরোনো রথ সেগুলো, ততোদিনেও স্পোক সহ চাকার ধারণা পায় নি হিকসসেরা।
নিজের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করলো মেমনন। বন্যার মৌসুমে জলপ্রপাত পেরিয়ে গজ-দ্বীপের দখল নিয়ে নেবো আমরা। এরপর, যখন দক্ষিণে তার বাহিনী নিয়ে ধেয়ে আসবে স্যালিতিস, থিবেসের পথে এগিয়ে যাবে মিশরীয় বাহিনী। পথে পথে জনতার জাগরণ আমাদের সঙ্গী হবে।