বহুমাস হয়ে গেছে তবে, ওর বুকে শুয়েছি আমি, ধীর কণ্ঠে বলে লসট্রিস। মাথা নেড়ে সায় দিলাম, কোন্ দিকে যাচ্ছে কথা-বার্তা ঠিক বুঝছি না।
প্রতিরাতে ওকে স্বপ্ন দেখেছি আমি, টাইটা। এমন কী হতে পারে, ঘুমন্ত অবস্থায় এসে আমার গর্ভে তার বীজ রেখে যেতে পারে ট্যানাস?
দেবতার ইচ্ছে হলে সবকিছুই সম্ভব, সতর্কস্বরে উত্তর দিলাম আমি। আমরা তেহুতি আর বেকাথার জন্ম সম্পর্কে সবাইকে এমন কথাই শুনিয়েছি। কিন্তু সত্যি বললে, এমন কিছু কখনো ঘটতে শুনিনি আমি।
বেশ কিছু সময় নীরব হয়ে রইলাম আমরা দু জন। নৌকার ধার দিয়ে নদীর পানিতে হাত ডুবিয়ে উঁচু করে ধরে রেখে টপটপ পড়তে থাকা ফোঁটাগুলোর দিকে চেয়ে রইলো লসট্রিস। এরপর আমার দিকে না তাকিয়ে বলে চলে সে, আমার ধারণা, বাচ্চা পেটে আমার, ফিসফিস করে বললো ও। আমার রজঃচক্র অনিয়মিত হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।
মিসট্রেস, শান্তস্বরে বললাম আমি। তুমি জীবনের এমন সময়ে চলে এসেছে, যখন গর্ভের নদী শুকিয়ে আসতে শুরু করে। আমাদের মিশরীয় মেয়েরা মরু ফুলের মতোই; আগে জন্মে, আবার দ্রুতই ঝরে যায়।
মাথা নাড়লো লসট্রিস। না, টাইটা। এটা সে রকম নয়। আমি টের পাই, আমার ভেতরে বড়ো হচ্ছে একটি শিশু।
নীরবে ওর দিকে চেয়ে থাকলাম আমি। আবারো, কেনো জানি না, মনে হলো মর্মান্তিক কোনো ঘটনা যেনো অদৃশ্য পাখায় ভর করে আমার কাঁধের পাশ দিয়ে উড়ে গেলো। হাতের রোম দাঁড়িয়ে গেছে আমার।
অন্য কোনো পুরুষের ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে না তোমার, এবারে সরাসরি আমার চোখে তাকিয়ে বললো লসট্রিস। তুমি জানোতা কোরি নি আমি।
তা আমি ভালো করেই জানি। কিন্তু কোনো ভূত এসে তোমাকে গর্ভবতী করে দিয়ে গেছে, এ আমি বিশ্বাস করি না। যতো প্রিয় ভূত-ই হোক না কেনো। সম্ভবত, আরো একটি সন্তান-প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা তোমার মধ্যে কল্পনার জন্ম দিয়েছে।
আমার পেট অনুভব করে দেখো, টাইটা, নির্দেশের সুরে বললো মিসট্রেস। আমার অভ্যন্তরে এ কোনো জীবিত বস্তু। প্রতিদিন বাড়ছে ওটা।
আজ রাতে পরীক্ষা করে দেখবো তোমার শয্যাকক্ষে। এখানে, এই নদী তীরে সম্ভব নয়।
*
লিনেন চাদরের উপর নগ্ন শুয়ে থাকলো আমার কর্মী, প্রথমে তার মুখ এবং পরে সমস্ত দেহ পরীক্ষা করে দেখলাম আমি। একজন পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এখনো যথেষ্ট আকর্ষণীয়া লসট্রিস; কিন্তু চিকিৎসকের চোখে দেখলে বুঝতে পারা যায় দীর্ঘ বছরগুলোর কষ্ট কী নির্মম পরিবর্তন এনেছে তার মধ্যে। রুপালি হয়ে গেছে চুল, ভুর কুঞ্চন স্থায়ী রূপ পেয়েছে। বয়স তার ছাপ ফেলেছে চেহারায়।
তিন তিনটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে ওর শরীর। বুকজোড়া শুকিয়ে গেছে এখন, গর্ভাবস্থার চিহ্ন দুধে ভারী হয়ে নেই ও দুটো। এ অবশ্য অস্বাভাবিক রুগ্ন আকার–চর্বি-মাংস কিছু নেই ওখানে। কিন্তু পাতলা হাত পার সাথে অসামাঞ্জস্যপূর্ণভাবে সামনে বেরিয়ে এসেছে বিশাল পেট।
সন্তান জন্মানোর চিহ্ন বহনকারী রুপালি-সাদা ডোরাকাটা দাগ ভরা পেটটা যখন হাতিয়ে দেখলাম, কিছু একটা অনুভব করলাম হাতের নিচে। আমি জানি, জীবন নয় ওটা। এ যে মৃত্যু স্বয়ং।
কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওর পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে, খোলা পাটাতনে গিয়ে আকাশের তারাদের দিকে চেয়ে রইলাম নির্বাক। ঠাণ্ডা, কতো শত মাইল দূরে ওরা। কোনোকিছুতেই কিছু আসে-যায় না ওদের দেবতাদের মতোই। নক্ষত্ররাজীই হোক বা দেবতা–ওঁদের কাছে প্রার্থনা করে কোনো লাভ নেই।
আমার কর্ত্রীর দেহে বড়ো হতে থাকা বস্তুটি আমি চিনি। অন্যান্য অনেক মহিলার দেহে এই রোগ দেখেছি আমি। মৃত্যুর পর বহু নারী শবদেহ কেটে ওটা বের করে এনে পরীক্ষা করে দেখেছি। ভয়ঙ্কর, বিচিত্র আকৃতির মানুষ বা প্রাণীর কোনো কিছুর সাথে মিল নেই এর। লাল-ভয়ঙ্কর এক মাংসপিণ্ড ওটা। সেথ্-এর জিনিস।
অনেকটা সময় লাগলো শয্যাকক্ষে ফিরে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে।
আলখাল্লা দিয়ে শরীর ঢেকে ফেলেছে মিসট্রেস। বিছানার মধ্যিখানে বসে, চিরসজীব বড়ো বড়ো গাঢ় সবুজ চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলো সে। মনে হলো, আমার পরিচিত সেই ছোট্ট মেয়েটি যেনো।
মিসট্রেস, ব্যথার কথা আমাকে বলো নি কেনো? মৃদুকণ্ঠে জানতে চাইলাম।
কেমন করে ব্যথার কথা জানলে তুমি? ফিসফিস করে উচ্চারণ করে আমার কর্ত্রী । ওটা যে লুকিয়ে রাখতে চাইছিলাম আমি।
.
চাঁদের আলোয় রুপালি মরুপথ ধরে রওনা হলো আমাদের কাফেলা। কখনো কখনো মিসট্রেস আমার পাশে পাশে হেঁটে চলতো, সাথে থাকতো দুষ্ট দুই রাজকুমারী। অভিযানের আনন্দে মশগুল তারা। মাঝে-মধ্যে যখন অসহনীয় হয়ে উঠতো পেটের ব্যথা, ওয়াগনে শুয়ে আরাম করতো লসট্রিস। ঘুমের গুড়ো ওর চোখ ভারী করে না আসা পর্যন্ত হাত ধরে বসে থাকতাম আমি।
প্রতিরাতে এক একটি পানি বহনকারী ওয়াগন পর্যন্ত দূরত্ব অতিক্রম করলাম আমরা। বহু বাহনের চলাচলে ততক্ষণে দাগ পরে গেছে বালুর বুকে। লম্বা দিনগুলোতে ওয়াগনের ছায়ার নিচে গরমে হাঁফাতাম।
তিরিশ দিন-রাত চলার পর একদিন সকালে স্মরণীয় দৃশ্য চোখে পড়লো। মরুর উপরে যেনো ভেসে চলেছে একটা পাল, কোনো বাহন নেই। আরো বহু মাইল পথ পাড়ি দেয়ার পর বোঝা গেলো, বোকা বনেছি আমরা। নীল নদের তীর আমাদের চোখের আড়াল করে রেখেছিলো গ্যালির কাঠামো, বালিয়ারির নিচে বয়ে চলেছে। নদী সেই গ্যালিরই পাল দৃশ্যমান হয়েছিলো দূর থেকে। নদীর বাঁক পেরিয়ে এসেছি আমরা।