যদিও আমার পদ ছিলো রাজকীয় আস্তাবলের পরিচালক, আমি রাজপুত্র মেমননের সভাসদের তালিকায় স্থান পেলাম। মাঝে-মধ্যেই যাত্রা পথের বাহন নিয়ে আমার পরামর্শ চাইতো রাজপুত্র। দিনের বেলায় ওর রথ চালিয়ে সৈন্যদের প্রশিক্ষণে নিয়ে যেতাম।
কতো রাত আমরা তিনজন, ক্ৰাতাস, আমি এবং মেমনন, সুরার পাত্র হাতে ফিরে যাওয়া নিয়ে কথা বলেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সেই রাতগুলোতে রাজকুমারী মাসারা থাকতো আমাদের সাথে। সবার পাত্র পূর্ণ করে দিতো সে। এরপর মেমননের পায়ের কাছে, ভেড়ার চামড়ায় তৈরি মাদুরের উপর বসে মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি কথা শুনতো সে। আমার উদ্দেশ্যে হাসতো মাসারা, চোখাচোখি হলে।
আমাদের মূল উদ্বেগ ছিলো নদীর ভাটিতে দুর্গম জলপ্রপাতগুলো অতিক্রম না করে ফিরে যাওয়া। ওই জলপ্রপাতগুলো কেবলমাত্র বন্যার সময়ে পার হওয়া সম্ভব। এতে করে আমাদের যাত্রাপথে অনেক সময় নষ্ট হবে।
আমি পরামর্শ দিলাম, পঞ্চম জলপ্রপাতের নিচে আরো একটা নৌবাহিনী তৈরি করতে পারি আমরা; তাতে চড়ে আমাদের সেনাবাহিনী মরুর সেই এলাকায় চলে যেতে পারবে, যেখান থেকে মরুর উপর দিয়ে সংক্ষিপ্ত রাস্তা ধরে এগুনো সম্ভব। প্রথম জলপ্রপাতের উপরে, নদীর কাছে পৌঁছে আবারো গ্যালি প্রস্তুত করে বাকি পথ পাড়ি দিয়ে গজদ্বীপে পৌঁছানো যাবে।
আমি নিশ্চিত ছিলাম, যদি আমাদের সময়জ্ঞান সঠিক থাকে, জলপ্রপাত এড়িয়ে গিয়ে যদি আমরা গজ-দ্বীপে নোঙর ফেলা হিকসস্ বাহিনীকে চমকে দিতে পারি, সেক্ষেত্রে তাদের গ্যালি দখল করে নিয়ে আমাদের বাহিনীকে শক্তিশালী করা সম্ভব। একবার, ঘঁটি গেলে ফেলতে পারলে আমাদের পদাতিক বাহিনী আর রথবহর প্রথম জলপ্রপাত অতিক্রম করে নীল নদের সমভূমিতে লড়তে পারবে।
পরবর্তী বন্যার মৌসুমে আমাদের প্রত্যাবর্তন শুরু হলো। কেবুই-এ, বহু বছর ধরে যা ছিলো আমাদের ঘাঁটি, একটা বাহিনী মোতায়ান রাখলাম আমরা। কেবুই আমাদের রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ঘাটি হিসেবে বিবেচিত হবে। কুশ এবং ইথিওপিয়ার মূল্যবান পণ্য এখন সহজেই আমাদের বন্দরে যেতে পারবে।
আবারো যখন মূল নৌ-বাহিনী উত্তরে যাত্রা শুরু করলো; পাঁচহাজার রাখাল এবং রথবহর সহ আমি এবং হুই নৃ-এ পালের স্থানান্তর অভিযানের অপেক্ষায় ছিলাম। আগের মতোই ঝাঁকে ঝাকে এলো তারা। রথ নিয়ে ওগুলোর মাঝে ছুটলাম আমি এবং
ধীরগতির এই প্রাণীগুলোকে ধরতে কোনো বেগ পেতে হলো না। রথ নিয়ে দৌড়ে দড়ির ফাঁস পরিয়ে খুব সহজেই ধরা গেলো, দ্রুতগামী ঘোড়ার সাথে দৌড়ে পেরে উঠলো না । নীল নদের তীরে প্রস্তুত করা খোয়ারে দশ দিনের মধ্যে প্রায় ছয় হাজার ন্যূ র স্থান হলো ।
সেই খোয়াড়ে থাকার সময়ই এই প্রাণীগুলোর নাজুক স্বাস্থ্য এবং দুর্বলতা পরিষ্কার হলো আমাদের কাছে। কোনো কারণ ছাড়াই শ য়ে শ য়ে মরলো তারা।
অর্ধেক প্রাণী মারা গেলো যথেষ্ট পরিমাণ যত্ন-আত্তির পরেও। শেষমেষ অল্প কয়েকটি প্রাণী আমরা নিয়ে যেতে পেরেছিলাম গ্যালিতে করে ।
*
রানি লসট্রিসের মিশর প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা দেওয়ার ঠিক দুই বছর পর, চতুর্থ জলপ্রপাতের উপরে নীল নদের পুব তীরে জড়ো হলো আমাদের লোকেরা। আমাদের নিচে, নদীর উপর দিয়ে চলে গেছে মরুপথ।
গত বছরের প্রায় পুরোটা সময় এখান থেকে ওয়াগনের কাফেলা রওনা হয়েছে। কাদামাটির পাত্রে কানায় কানায় নীলের জলভর্তি করে মুখবন্ধ অবস্থায় ওয়াগনে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ধুলোময় পথের দশ মাইল অন্তর অন্তর পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ এবং প্রায় সমসংখ্যক প্রাণী রয়েছে আমাদের সাথে। প্রতিদিন পানি ভর্তি ওয়াগন চরে যেতে থাকলো মরুপথ ধরে এর যেনো কোনোদিন শেষ হবে না।
নতুন চাঁদের অপেক্ষায় নদী তীরে বসে রইলাম আমরা, যাতে রাতে চাঁদের আলোয় এগুতে পারি। যদিও বছরের ঠাণ্ডা সময়ে এই যাত্রা করতে হচ্ছে, কিন্তু মরুর সূর্যের প্রখর তাপ আমাদের বাহিনীর লোকজন এবং প্রাণীগুলোর জন্যে অসহনীয়।
পথ-চলার দুই দিন আগে, আমার কী হঠাৎই বললো আমাকে, টাইটা, শেষ কবে তুমি আর আমি নদীতে মাছ ধরেছি? নৌকা আর সরঞ্জাম তৈরি করো গে, যাও।
বুঝলাম, বিশেষ কোনো ব্যাপারে কথা বলতে চায় সে। সবুজ জলে ভেসে চললো আমাদের ছোটো নৌকা; দূরের তীরের আগাছার সাথে দড়ি বেঁধে নৌকা স্থির করলাম আমি। এখন আর আমাদের কথা শুনতে পাবে না কেউ।
প্রথমে, মরুপথ ধরে আমাদের আসন্ন যাত্রা নিয়ে কথা বললাম আমরা দু জন। থিবেস প্রত্যাবর্তন নিয়ে উত্তেজিত হয়ে আছি সবাই।
ওই ঝকঝকে দেয়ালগুলো কবে আবার দেখতে পাবো, টাইটা? দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো আমার কর্ত্রী। এ এমন এক প্রশ্ন যার উত্তর জানা নেই আমার।
যদি দেবতারা সদয় থাকেন, আগামী বছর এই সময় গজ-দ্বীপে থাকবো আমরা। বন্যার পানিতে আমাদের জাহাজবহর প্রথম জলপ্রপাত অতিক্রম করতে সক্ষম হবে। এরপর, এই নদীর মতোই ঝড়-ঝঞ্ঝা সইতে হবে আমাদের–বড়ো এক যুদ্ধ অপেক্ষা করছে সামনে।
কিন্তু, এসব নয়, আমি জানি অন্য কিছু নিয়ে আলাপ করতে এখানে এসেছে লসট্রিস।
কতোদিন হলো ট্যানাস আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, টাইটা? জলভরা চোখে জানতে চাইলো সে।
রুদ্ধ স্বরে উত্তর দিলাম, তিন বছর আগে স্বর্গের ময়দানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে সে, মিসট্রেস।