বিয়ের সময়ে প্রেমিক যুগলের কাছাকাছি থাকার সম্মান পেয়েছিলাম আমি। যদিও লসট্রিসের কথা সত্য কোনো বিষয়েই মিল নেই বর-কনের, তথাপি ওদের হৃদয় এক ও অভিন্ন। আমি দু জনের কাছেই ছিলাম বিশ্বস্ত বন্ধু। ওদের মিলনের ক্ষেত্রে আমার ভূমিকার কথা বারবার স্মরণ করলো দুজন।
আমার কর্ত্রীর দুশ্চিন্তা আমাকে স্পর্শ করলো না। মাসারা এবং মেমনন পরস্পরের জন্যেই তৈরি। জানি, কখনো মেমননকে লক্ষ্যচুত করবে না এই মেয়ে। বরঞ্চ উৎসাহ আর সমর্থন দিয়ে তরতাজা করে রাখবে আমাদের যুবরাজকে।
এক আলোকজ্জ্বল সকালে, পর্বতের উপরে বিশ হাজার ইথিওপিও নারী-পুরুষ এবং মিশরীয় নাগরিকের সামনে মেমনন এবং মাসারা নদী তীরে দাঁড়িয়ে ওসিরিসের মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের ভোলা নীলের জলভর্তি পাত্র ভেঙে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলো।
বর-কনে আমাদের কাফেলার সামনে থেকে নেমে এলো পর্বতাঞ্চল থেকে। ওয়াগন বোঝাই যৌতুক দিয়েছে প্রেসটার বেনি-জন।
হুই এবং তার সাহায্যকারীরা আমাদের পিছনে পঁচ হাজার শক্তিশালী ঘোড়ার পাল নিয়ে এগুলো। এদের মধ্যে কিছু মাসারাকে উদ্ধার করে আনার পুরস্কার, বাকিগুলো যৌতুক। কেবুই-এ, জোড়া নদীর মিলনস্থলে পৌঁছে আমরা দেখতে পেলাম, মেঘের ছায়ায় যেনো কালো হয়ে গেছে পুরো সমভূমি। কিন্তু চারিদিকে রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া।
বার্ষিক স্থানান্তর অভিযানে চলেছে ন্যূ-এর পাল।
স্বাভাবিক কারণেই চিন্তিত হয়ে পড়লাম আমি এবং হুই। আবার সেই মহামারীর আশঙ্কা অমূলক তো নয়; কিন্তু তৈরি আছি আমরা। প্রত্যেকটি রথ চালক এবং সহিসকে শ্বাসনালী ফুটো করে হলুদ-ফাঁস রোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। বহু রাত পর্যন্ত নির্মুম কাটালাম আমরা, কিন্তু শেষমেষ পাহাড়ি ঘোড়ার পালের কেবলমাত্র দুই হাজার ঘোড়া মারা পড়লো মহামারীতে। নীলের জল্যে পরবর্তী বন্যার আগে অসুস্থ ঘোড়গুলোও শক্তি ফিরে পেলো।
*
বন্যা এলে নদীর তীরে নিজের নিজের দেবতাদের উদ্দেশ্যে দান করলেন পুরোহিতেরা। নিজেদের মধ্যে দেবতার চিহ্ন নিয়ে বলাবলি করতে শুরু করলেন তারা। কেউ বলি দেওয়া ভেড়ার নাড়ি, কেউ আবার উড়ন্ত পাখির গতিপথকে পবিত্র মনে করলেন; আবার এমনলোকও আছেন যারা নীলের জলভর্তি পাত্রের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।
হাপির উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করলো রানি লসট্রিস। যদিও তার সাথে প্রার্থনায় যোগ দিলাম আমি, আমার হৃদয় ছিলো অন্য কোথাও। আমি হোরাসের উপাসক, ক্ৰাতাস এবং রাজপুত্র মেমননও তাই। স্বর্ণ আর আইভরি উৎসর্গ করে দেবতার নামে স্তুতি গাইলাম আমরা।
দেবতারা একে অপরের সাথে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেরই একমত হন না, আর তাদের উপাসকেরা তো আরো হয় না। কিন্তু এ বছর অন্যান্য বারের চেয়ে ভিন্ন রকম হলো। দেবতা আনুবিস এবং তথ আর দেবী নাটু বাদে সমস্ত দেবতারা যেনো এক সুরে কথা বোলগ্ন। ওই তিন দেব-দেবী অবশ্য নিচু পদ-পর্যাদার। সমস্ত মহান দেব দেবী আমন রা, ওসিরিস, হোরাস, হাপি এবং আইসিস, এবং আরো দুইশো নীচ পদ-মর্যাদার বিভিন্ন দেবতা এক যোগে তাদের পরামর্শ শোনালেন : সময় এসে গেছে পবিত্র কালো ভূমি, কেমিট ফিরে যাওয়ার!
লর্ড ক্ৰাতাস, যে আদতে কোনো দেব-দেবীর ধার ধারে না, মতামত জানালো, এ হলো পুরোহিতদের ষড়যন্ত্র; ইচ্ছেকৃতভাবেই সমস্ত দেবতাদের ঠোঁটে একই কথা বলিয়ে নিয়েছে তারা। যদিও তার এহেন ভয়ঙ্কর অভিযোগে কেঁপে উঠেছিলাম, মনে মনে কাতাসের সঙ্গে আমিও একমত।
পুরোহিতেরা হলেন নরম আর আরামপ্রিয় মানুষ। দীর্ঘ প্রায় দুই দশক যাযাবরের মতো বন্য কুশ দেশের ভূখণ্ডে ঘুরে ফিরেছেন তারা। আমামার ধারণা, থিবেস-নগরীর জন্যে আমার কর্ত্রীর চেয়ে তাদের মন বেশি উতলা হয়ে পড়েছে। হয়তো, দেবতারা নয়, মানুষেরাই তাদের ঠোঁটে দেশে ফিরে যাওয়ার শব্দ তুলে দিয়েছিলো।
রাজ্যের উচ্চ পরিষদের সভা ডাকলো লসট্রিস। যখন দেবতাদের ইচ্ছে অনুযায়ী মিশরে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা উচ্চারণ করলো ও, মহৎপ্রাণ পুরোহিতো পায়ের উপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সমর্থন জানালো তাকে। তাদের যে কারো চেয়ে বেশি আনন্দ করেছিলাম আমি। সেই রাতে থিবেস-এর স্বপ্নে বিভোর হয়ে সুখী দিনগুলোর কথা ভাবলাম, যখন ট্যানাস, লসট্রিস এবং আমি ছিলাম তরুণ আর উচ্ছল ।
৯. ট্যানাসের মৃত্যুর পর
ট্যানাসের মৃত্যুর পর থেকে কোনো প্রধান সেনাপতি ছিলো না আমাদের, যুদ্ধ-সভা বসলো গোপন স্থানে। যদিও সেখানে যাওয়ার অনুমতি ছিলো না আমার, কিন্তু লসট্রিসের কাছে সব কথাই শুনেছিলাম।
বহুসময় ধরে তর্ক-বিতর্ক শেষে সমরনায়কের পদে ক্ৰাতাসকে মনোনীত করা হলো। সমস্ত লোকজনের সমানে দাঁড়িয়ে বুড়ো সিংহের মতোই হুঙ্কার দিয়ে হেসেছিলো ক্ৰাতাস। সে বলেছিলো, আমি একজন সৈনিক। আমি নির্দেশ পালন করি। নেতৃত্ব দেওয়া আমার কাজ নয়। তলোয়ার খাপমুক্ত করে মেমননের দিকে তাক করে ধরে সে, ওই সেই ব্যক্তি, যার নির্দেশ পালন করবো আমি। জয় হোক, মেমননের! তিনি চিরজীবি হোন।
তিনি চিরজীবি হোন! চেঁচিয়ে উঠে সবাই। হাসি ফুটে উঠলো আমার মিসট্রেসের ঠোঁটে। আমি আর ও মিলেই মূলত এই পরিকল্পনা করেছিলাম।
বাইশ বছর বয়সে মিশরের সাহসী সিংহ পদে পদোন্নতি পেয়ে প্রধান সেনাপতির দায়িত্বভার পেলো মেমনন । সাথে সাথেই মিশর ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলো সে।