ঝাপসা হলুদ আলোতে দেখতে পেলাম, আমার কর্ত্রীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, বিবর্ণ লাগছে ওকে। গায়ে গা ঠেকানো জনতার ভিড় ঠেলে ওর কাছে পাশে পৌঁছুলাম আমি মাত্র সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লো লসট্রিস। পাথুরে শবাধারে কোণায় লেগে মাথা ফাটার আগেই ওকে ধরে ফেললাম।
সমাধি থেকে একটা ভুলায় করে বের করে নিয়ে আসা হলো ওকে। পর্বতের তাজা বাতাসে অল্পসময়ের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠলো লসট্রস, কিন্তু জোর করে বিছানায় শুইয়ে রাখলাম আমি তাকে। তবু ছেড়ে বেরুতে দিলাম না ।
রাতে, যখন লতাগুলোর মিশ্রণ তৈরি করছিলাম ওর তাবুতে, চিন্তিত ভঙ্গিতে স্থির শুয়ে রইলো সে। মিশ্রণ পান করা শেষ হতে, ফিসফিস করে বললো, ফারাও-এর কবরের কাছে দাঁড়িয়ে থাকার সময় এক অস্বাভাবিক অনুভূতি হয়েছিলো আমার, টাইটা। হঠাৎ মনে হলো, আমার খুব কাছেই এসেছে ট্যানাস। মনে হলো, আমার হাত ছুঁলো ও, কানে যেনো ওরই কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। ওই সময়ই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাই।
ও সব সময়ই তোমার কাছেই থাকবে, বললাম আমি তাকে ।
আমিও তাই বিশ্বাস কোরি, একভাবে বললো লসট্রিস।
যদিও তখন টের পাই নি, এখন বুঝি, ট্যানাসকে কবরে শোয়ানোর দিন থেকেই ওর সময় ফুরিয়ে আসছিলো। বেঁচে থাকার স্পৃহা, আনন্দ সেই দিন থেকেই হারিয়ে ফেলেছিলো আমার রানি।
*
পরদিন ক্রীতদাসের বিশাল এক দল এবং রাজমিস্ত্রিদের নিয়ে আবারো সমাধি-উপত্যকায় ফিরে গেলাম আমি; সমাধির প্রবেশমুখ এবং শ্যাফট বন্ধ করা এবং বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা তৈরির কাজ বাকি পড়ে আছে।
গলিপথের গোলকধাঁধা দিয়ে পথ করে যখন এগুতে লাগলাম, ধূর্ততার সাথে পাথরধসের ব্যবস্থা করে সেগুলোর উপর আস্তরণ তৈরি করে রঙিন ছবি এঁকে দিলাম আমি। শ্যাফট দুটোকে সীল করা হলো এমনভাবে, দেখে মনে হয় ওগুলো মেঝে এবং ছাদ।
টিল-করা কোনো পাথরের পাদানীতে চাপ পড়লে শুরু হবে পাথরধস। খাড়া শ্যাফটগুলোতে বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ি সাজিয়ে রাখলাম। কালের আঁচড়ে যখন পচে যাবে কাঠ, কীটপতঙ্গ বাসা বাঁধবে ওখানে তৈরি হবে বিষাক্ত গ্যাস। গুপ্ত দরোজার বিপদ পেরিয়ে কেউ যদি শ্যাফট পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে, এই গ্যাসে শ্বাস নিয়ে মারা পড়বে সে।
কিন্তু, এ সমস্ত করার আগে মূল সমাধি-প্রকোষ্ঠে গিয়ে বিদায় নিয়ে এলাম ট্যানাসের কাছ থেকে। লিনেনের কাপড়ে মুড়ে লম্বা একটা বান্ডেল নিয়ে গেলাম সাথে । শেষবারের মতো যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম পাথুরে শবাধারের কাছে, সমস্ত শ্রমিকদের দূরে সরিয়ে দিলাম আমি। আমার পরে আর কারো পা পড়বে না এই সমাধিতে।
একা হতে কাপড়ের পুঁটুলিটা খুললাম। সেই লম্বা ধনুক লানাটা বেরুলো ওটা থেকে। আমার মিসট্রেসের নামে এটার নাম দিয়েছিলো ট্যানাস। কেবলমাত্র ওরই জন্যে আমি তৈরি করেছিলাম ধনুকটা। আমাদের দু জনের পক্ষ থেকে শেষ এই উপহার ট্যানাসের জন্যে। সীল করা পাথরের কফিনের ডালার উপরে ওটা রেখে দিলাম।
আরো একটা জিনিস ছিলো পুঁটুলিতে। আমার নিজহস্তে খোদাই করা একটা উশব তি পুতুল ওটা। শবাধারের পায়ের কাছে রাখলাম ওটা। ওটা খোদাই করার সময় তামার আয়না রেখেছিলাম সামনে যাতে করে নিজের অবয়ব নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারি। পুতুলটা ছিলো একটা ছোটো টাইটা।
পুতুলের নিচের অংশে কাঠ খোদাই করে লিখেছিলাম : আমি টাইটা। আমি একজন চিকিৎসক এবং কবি। আমি একজন স্থপতি এবং দার্শনিক। আমি তোমার বন্ধু। তোমার পক্ষ থেকে আমি জবাবদিহি করবো।
সমাধি ছেড়ে বেরিয়ে প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো পিছু ফিরে চাইলাম।
বিদায়, বুড়ো বন্ধু, বললাম। তোমার সাথে পরিচিত হয়ে ধন্য হয়েছি। আবার দেখা হবে মরণের ওপারে।
রাজকীয় সমাধির কাজ শেষ করতে বহু মাস সময় লেগেছিলো আমার। প্রতিটি সীল করা দরোজা, মৃত্যু-ফাঁদ পরখ করে দেখেছি আমি নিজে।
প্রেমটার বেনি-জনের সাথে দেখা করতে পর্বতের উপরে গেছে রাজপুত্র আর রানি। মেমনন এবং মাসারার বিয়ে উপলক্ষ্যে পুরো সভাসদ গিয়েছে সাথে। আদবার সেজেদ-এ যুদ্ধ জয়ের পুরস্কার স্বরূপ যে ঘোড়া দেওয়ার প্রতিশ্রতি করেছিলো সেটার বেনি-জন, সেগুলো পছন্দ করার জন্যে হুই-ও গিয়েছে সাথে। এখানে একদম একা আমি। কাজ শেষ হতে ঠাণ্ডা, স্যাঁত-স্যাঁতে পথে নিজেও রওনা হলাম পর্বতের উপরে। বিয়ের উৎসবে থাকতে চাই আমি। সমাধি উপত্যকার প্রবেশমুখ আড়াল করতে ধারণার চেয়েও বেশি সময় লেগেছে।
বিয়ের পাঁচদিন আগে প্রেসটার বেনি-জনের এলাকায় পৌঁছলাম। মিসট্রেস দুর্গের যে অংশে আছে, প্রথমেই সেখানে গেলাম ।
তোমাকে না দেখে ভালো লাগছিলো না, টাইটা, লসট্রিস স্বাগত জানিয়ে বললো। গান গাও আমার জন্যে। গল্প বলো। আমাকে শান্তি দাও।
আত্মার গভীরে বিষণ্ণতা ঢুকে গেলে আর শান্তি পায় না মানুষ। আমি নিজেও কেমন আনমনা হয়ে গেছি। শেষমেষ রাজত্বের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে চললাম আমরা দুজন।
মাসারা এবং মেমননের মিলন প্রকৃতপক্ষে দুটি তরুণ হৃদয়ের ভালোবাসার সফল পরিণতি। কিন্তু আমাদের কাছে এটা মূলত দুই জাতির মধ্যে চুক্তির মাধ্যম। বিভিন্ন বিষয়ে একমত হওয়ার ব্যাপার আছে, যেমন যৌতুক, আকসুম প্রদেশ এবং মিশরের মধ্যে বাণিজ্যিক বিনিময়ের কথাও রয়েছে। প্রথমটায় আমার ধারণা মতো এই বিয়েতে সুখী ছিলো না রানি। পরে অবশ্য মনকে প্রবোধ দিয়েছিলো সে।