মেমননের নেতৃত্বে সামনে থাকলে প্রথম রথবহর। পিছনে রইলো পঞ্চাশটি মাল বহনকারী ওয়াগন, যাতে ফারাও মামোসের সমাধি-সম্পদ বোঝাই হয়ে আছে। রাজ-বিধবা, রানি লসট্রিস থাকলো স্বণের কফিন বহনকারী ওয়াগনের সঙ্গে। ভালোবাসার মানুষের সাথেই শেষ-যাত্রায় চলেছে ট্যানাস–এটা ভেবে দারুন ভালো লাগলো আমার, যদিও লসট্রিস জানতো না সেটা। মাঝে-মধ্যেই পিছন ফিরে, লম্বা কাফেলার শেষমাথায় তাকাচ্ছিলো সে।
কাফেলার পিছনে, হালকা কাঠের কফিনের পিছুপিছু হেঁটে আসছিলো শিলুক বাহিনী। সারির মাথায় আমাদের কাছে পরিষ্কার ভেসে এলো তাদের শোকসংগীত । আমি জানি, ট্যানাস শুনেছে সেই গান, জানে, কার উদ্দেশ্যে এই নিবেদন।
*
সমাধি-উপত্যকায় যখন পৌঁছুলাম আমরা, রাজ-সমাধির প্রবেশদ্বারে নির্মিত তাবুতে নামিয়ে রাখা হলো স্বর্ণের কফিন। লিনেন তাঁবুর ছাদে জ্বলজ্বল করলো মৃতের পুস্তক থেকে নেওয়া বিভিন্ন উদ্ধৃতি ।
দুটি ভিন্ন শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন রয়েছে। প্রথমটি, অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্ণের মিশরের সাহসী সিংহের। পরেরটি, রাজকীয় জাঁক-জমকের সাথে পালিত হবে।
কাজেই, সমাধি-উপতকায় আমাদের আগমনের তিন দিন পর, ট্যানাসের জন্যে আমার নির্মাণ করা সমাধিতে রাখা হলো কাঠের কফিন। সুর করে গাইলো হোরাসের মন্দিরের পুরোহিতেরা যে হোরাস ছিলেন ট্যানাসের পিতৃ-দেবতা। এরপর, সীল করে দেওয়া হলো সমাধি।
শেষকৃত্যের সময়টাতে একজন বিশ্বস্ত ভূত্যের মৃত্যুতে রানির যতোটুকু শোক করা উচিত, তার চেয়ে বেশি কিছু দেখালো না লসট্রিস। আমি ঠিকই বুঝছিলাম, ওর ভেতরে কিছু একটা মরে যাচ্ছে, আর কখনোই যা জাগবে না।
সারাটা রাত ধরে গাইলো শিলুকেরা। ওদের কাছে দেবতায় পরিণত হয়েছিলো ট্যানাস। আজকে পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে ওর নাম নিয়ে হুঙ্কার ছাড়ে শিলুক গোত্র ।
দশদিন পর, স্বর্ণের কফিনটা তোলা হলো কাঠের স্লেজে; অতপর ওটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো বিশাল রাজ-সমাধির কাছে। গলিপথ ধরে ঢোকাতে তিনশো দাসের প্রাণান্ত পরিশ্রম প্রয়োজন হয়েছিলো। এমন চমৎকার মাপে তৈরি করেছিলাম সেই সমাধি, কফিন বসানোর পর হাত গলানোরও জায়গা রইলো না।
ভবিষ্যতে সমাধি-চোর এবং সমাধি-লক্ষ্মনকারীদের হাত থেকে বাঁচতে পর্বতের নিচে গলিপথের এক গোলকধাঁধা তৈরি করেছিলাম আমি। পাথুরে প্রবেশ মুখে, একটি গলিপথ সোজা চলে গেছে অসাধারণ এক সমাধি প্রকোষ্ঠে যেখানকার দেয়ালে শোভা পাচ্ছে রঙ-বেরঙের চমৎকার সব মুর্যাল। সেই কক্ষের কেন্দ্রে রয়েছে বিশাল এক শবাধার, নাটকীয়ভাবে ডালা খোলা অবস্থায় পড়ে আছে সেটা। প্রথম সমাধি-চোর, যে এখানে প্রবেশ করবে, এ দেখে ধোকা খেয়ে যাবে। হয়তো তার আগেই অন্য কেউ এসে লুটে নিয়ে গেছে যাবতীয় সম্পদ–এমন ভাবতে পারে সে।
মূলত, প্রবেশদ্বার থেকে সমকোণে ভিতরে চলে গেছে আরো একটি গলিপথ। তার প্রবেশমুখ দেখে মনে হয়, সমাধি-সম্পদ রাখার কক্ষ সেটা। স্বর্ণের কফিন উল্টে, কাত করে তবেই সম্ভব হলো সেই গলিপথ ধরে ঢোকা। সেখান থেকে অসংখ্য গলিপথ চলে গেছে বিভিন্ন ভুয়া প্রকোষ্ঠে আর কবরে। প্রতিটি গলিপথ একে অপরের চেয়ে বেশি সর্পিল, ধাঁধার মতো।
মোটমাট চারটি সমাধি প্রকোষ্ঠ রয়েছে সেখানে। যার মধ্যে তিনটি চিরকাল ফাঁকা পড়ে থাকবে। তিনটি লুকোনো দরোজা আর দুটি শ্যাফট আছে, যার একটি ধরে পুড়ে উঠিয়ে পরেরটি ধরে রাজ-কফিন রাখব্দেবতারা আমাকে
এই গোলকধাঁধা পেরিয়ে রাজ-কফিন রাখতে পনেরোদিন লেগে গেলো। অবশেষে, তার শেষ বিশ্রামস্থানে পৌঁছুলো সেটা। দেবতারা আমাকে যতোটুকু সাধ্য দিয়েছেন, তার সবটুকু ব্যবহার করে দেয়াল আর ছাদে আঁকলাম আমি। এমনকি, আমার বুড়ো আঙুলের সমান জায়গাও ফাঁকা রইলো না। রঙ-বেরঙের দেয়ালচিত্রের এক অপূর্ব প্রদর্শনীর সাক্ষী হয়ে রইলো সমাধি-প্রকোষ্ঠটি।
সেই প্রকোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে গেছে পাঁচটি ভাড়ার ঘর। ওগুলোতে স্থান হলো ফারাও মামোসের জীবনকালে সংগ্রহ করা সমস্ত সম্পদ যার কারণে ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছিলো আমাদের এই মিশর।
আমি মিসট্রেসকে বলেছিলাম, মাটির তলায় চাপা দেওয়ার বদলে ওগুলো ব্যয় করে আমাদের সেনাবাহিনীর কল্যাণ সাধন করতে। হিকসস্দের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন আমাদের।
ওই সম্পদ ফারাও-এর, উত্তরে বলেছিলো লসট্রিস। স্বর্ণ, আইভরি আর দাসসমেত বিশাল সম্পদ পেয়েছি আমরা এই কুশ দেশে। আমাদের জন্যে যথেষ্ট ওটা। স্বর্গীয় মামোস নিজের জিনিস নিয়ে চিরবিশ্রাম নিন–এ ব্যাপারে তার কাছে শপথ করেছি আমি।
এইভাবে, পনোরোতম দিনে স্বর্ণের কফিন রাখা হলো পাথর কেটে তৈরি করা শবাধারে। দড়ি আর পুলির সহায়তায় ভারী ডালাটা বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হলো।
রাজ-পরিবার, পুরোহিত আর মহৎপ্রাণেরা সর্বশেষ আচার পালন করার জন্যে সমাধি-প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলেন।
শবাধারের মাথার কাছে দাঁড়ালো আমার কী আর রাজকুমার, মন্ত্র আবৃত্তি করে চললেন পুরোহিতবর্গ-মৃতের পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি করছেন তারা। প্রদীপের আলো থেকে এঁকে-বেঁকে উপরে উঠে যাচ্ছে ধোয়ার রেখা। সমবেত লোকজনের নিঃশ্বাসে ভারী হয়ে গেছে প্রকোষ্ঠের বাতাস। শ্বাস নেওয়া দায়।