ওর পাশে গিয়ে নিচু স্বরে সতর্ক করলাম, মিসট্রেস, তোমার শোকের কথা যেনো সবাই ভালোভাবে বুঝতে না পারে। ওরা যেনো না জানে, কেবল প্রধান সেনাপতি নয়, আরো কিছু ছিলো সে তোমার। ওর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হলেও কান্না সামলাও।
চোখে আর পানি নেই যে, শান্ত স্বরে লসট্রিস বলে। কেবল তুমি আর আমি জানো সত্যিটা।
হোরাসের প্রশ্বাসে, ফারাও-এর বিশালাকায় স্বর্ণের কফিনের পাশেই স্থান হলো ট্যানাসের কাপড়ে তৈরি কফিনের। ট্যানাসের কাছে করা প্রতিজ্ঞামতো মিসট্রেসের পাশে রইলাম আমি। কিন্তু শোক এক অদ্ভুত নীরব বেদনা উপহার দিয়ে গেছে তাকে, আর কখনো স্বাভাবিক হতে পারে নি লসট্রিস। এরপর একদিন তার নির্দেশে ফারাও এর সমাধি-নির্মাণ কাজ তদারকি করতে সমাধি-উপত্যকায় ফিরে গেলাম আমি।
তার পরামর্শমতো ট্যানাসের সমাধির জন্যে উপত্যকার গভীরে ভিন্ন একটা স্থান। নির্বাচন করলাম। যদিও শিল্পীদের সাথে নিয়ে যথেষ্ট চেষ্টা কোরেছিলাম আমি, ফারাও এর সমাধির কাছে একটা গরিবী কুড়ের মতো দেখালে ট্যানাসের চিরবিশ্রামের স্থান।
এতোগুলো বছরে একদল শিল্পীর নিরলস প্রচেষ্টায় রাজার সমাধির গলিপথ আর মাটির অভ্যন্তরের প্রকোষ্ঠের দেয়ালে ঝলমল করছে অত্যাশ্চর্য দেয়ালচিত্র। সমাধির ভাড়ার ঘরে বোঝাই হয়ে আছে সুদূর থিবেস থেকে বয়ে নিয়ে আসা বিপুল পরিমাণ সমাধি-সম্পদ।
দ্রুততার সাথে ট্যানাসের সমাধিরনির্মাণকাজ সম্পন্ন হলো। দেশের এবং ফারাও এর সেবায় নিয়োজিত থেকে জীবনভর কোনো সম্পদ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয় নি সে। তার জীবদ্দশায় বিভিন্ন কীর্তি দেয়ালে এঁকে দিলাম আমি; শক্তিশালী জম্ভ শিকার অভিযান, লাল-ফারাও এবং হিকসস্দের সাথে মরণপণ যুদ্ধ, আদবার সেজেদ-এর শেষ লড়াই কিছুই বাদ গেলো না। কিন্তু মিসট্রেসের প্রতি তার ভালোবাসা বা আমার প্রতি তার বন্ধুত্বের উল্লেখ থাকলো না কোথাও। রানির প্রতি প্রণয় দেশদ্রোহিতারই নামান্তর। ক্রীতদাসের সঙ্গে বন্ধুত্ব পরিচয় দেয় হীনম্মন্যতার।
শেষপর্যন্ত যখন কাজ সম্পন্ন হলো, ট্যানাসের সেই আড়ম্বরহীন কবরে একা দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। এই সেই স্থান, যেখানে সময়ের শেষ পর্যন্ত শায়িত থাকবে ও; আচমকা রাগে আমার সর্বশরীর কেঁপে উঠলো–কেবল এ-ই করার আছে আমার ট্যানাসের জন্যে? আমার চোখে দ্বৈত-মুকুটধারী যে কোনো ফারাও-এর চেয়ে বড়ো মাপের মানুষ ছিলো সে। মুকুট ওর প্রাপ্য ছিলো, ওটা ইচ্ছে করলেন পেতে পারতো সে। আমার কাছে যে কোনো ফারাও-এর চেয়ে বড়ো সম্রাট ছিলো ট্যানাস।
ঠিক তখনই চিন্তাটা এসেছিলো মাথায়। এতো ভয়ঙ্কর সেই চিন্তা প্রথমে জোর করে ভুলে থাকতে চাইলাম। এমনকি, অমন ভাবাও দেশদ্রোহিতা এবং মানুষ ও দেবতাদের চোখে অসামান্য অপরাধ।
কিন্তু পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে আমাকে কুড়ে কুড়ে খেলো চিন্তাটা। ট্যানাসের কাছে আমার অনেক ঋণ, ফারাও-এর কাছে এর অর্ধেকও নেই। যদি কেউ আমাকে শাস্তিও দেয়, বন্ধুর জন্যে এটুকু করবো আমি।
একা এতো বড়ো কর্ম সম্পাদন সম্ভব নয় আমার পক্ষে। সাহায্য চাই কিন্তু কার কাছে চাইবো? রানি বা রাজপুত্রকে জানানোর প্রশ্নই উঠে না। ফারাওকে করা শপথ ভাঙতে পারবে না মিসট্রেস; আর রাজপুত্র তার আসল পিতার পরিচয় জানে না। আর তাছাড়া ট্যানাসের কাছে করা শপথ ভেঙ্গে তাকে সবকিছু খুলে বলা সম্ভব নয়।
শেষমেষ, যে ট্যানাসকে আমারই মতো ভালোবাসতো, যে না ভয় পায় মানুষকে, দেবতাদের সেই ক্ৰাতাসকে নির্বাচিত করলাম আমি।
সেথ্-এর অশুচি পাছার কসম! আমার পরিকল্পনা শুনে হাসিতে ফেটে পড়লো ক্ৰাতাস। তুমি ছাড়া আর কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারতো না ওটা। জীবিত সেরা জালিয়াত তুমি, টাইটা! কিন্তু ট্যানাসকে এই শেষ সম্মান জানানোর সুযোগ করে দেয়ায় তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আমি।
আমরা দুজনে মিলে সতর্ক পরিকল্পনা করলাম। এমনকি, হোরাসের প্রশ্বাসের ভাড়ার প্রহরীদের ঘুমের গুঁড়ো খাইয়েছিলাম।
অবশেষে ক্ৰাতাস এবং আমি সবার অগোচরে জাহাজের খোলের তলায়, কফিন রাখার স্থানে প্রবেশ করলাম। একটু কেঁপে উঠেছিলাম ভয়ে; মনে হয়েছিরো ফারাও মামোসের কা আমাকে দেখে রাখছে, আজীবন আমাকে তাড়া করে ফিরবে এর পর থেকে।
বিশাল ক্রাতাসের মনে এ ধরনের কোনো ভয়-ডর নেই, এমন দ্রুততার সাথে কাজ শুরু করলো সে, বারবার সতর্ক করে দিতে হলো যেনো শব্দ না হয়। স্বর্ণের কফিনের ডালা খুলে ফারাও-এর মমি বের করে আনলো ক্ৰাতাস।
ফারাও-এর তুলনায় অনেক বড়ো শরীর ট্যানাসের, ভাগ্যবশত কফিন প্রস্তুতকারীরা অনেকটা জায়গা রেখেছিলো, আর মমি করার পর ট্যানাসের শরীরও বেশ অনেকটা শুকিয়ে গেছে ততোদিনে। এতদ্সত্ত্বেও, মমির বেশ অনেকটা পরত খুলে তবেই ট্যানাসকে ফারাও-এর কফিনে ঢোকাতে সক্ষম হলাম আমরা।
কাঠের সাধারণ কফিনে ফারাও মামোসকে রাখার সময় বিড়বিড় করে ক্ষমা চাইলাম আমি, কফিনের ডালায় মিশরের সাহসী সিংহ উপাধি অংকিত। ফারাও-এর দেহ রাখার পরেও অনেক জায়গা ছিলো সেখানে। ট্যানাসের মমি থেকে খুলে আনা লিনেন কাপড়ে পট্রিগুলো সেখানে রেখেছিলাম আমরা।
*
বৃষ্টি কেটে যেতে আবার শীতের কাল এসে গেলো। কেবুই ছেড়ে শোকযাত্রায়, সমাধি-উপত্যকায় সবাইকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন রানি।