অনেক সম্মান দিলে আজ।
কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অস্ত্র হাতে ধ্রুপদি ভঙ্গিমায় দাঁড়ায় মেমনন। তলোয়ারের ফলা ঠোঁটে ঠেকিয়ে খাড়া রেখে সালাম জানায় মৃত্যুশয্যায় শায়িত সেনাপতিকে।
এরপর, দু পায়ের মাঝখানে তলোয়ারের ডগা মাটিতে রেখে দুই হাত হাতলে রেখে স্থির হয়ে দাঁড়ায় সে।
সব কিছু শিখে নিয়েছো তুমি। সন্তুষ্টি ধ্বনিত হলো ট্যানাসের কণ্ঠে। তোমাকে শেখানোর আর কিছু নেই আমার। মনে হয় না বেশী তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছি।
আমি অপেক্ষা কোরি এখানে, তোমার সাথে? মেমনন বলে।
না, কঠোর ভঙ্গিমায় বলে উঠে মিশরের বীরশ্রেষ্ঠ। এই সংকীর্ণ কক্ষের বাইরে তোমার অপেক্ষায় বসে আছে নিয়তি। একবারো পিছনে না ফিরে, যাও, বরণ করে নাও তাকে। টাইটা থাকুক আমার সাথে। মেয়েটাকেও নিয়ে যেও সঙ্গে। রানি লসট্রিসকে জানাও আমার বিদায়ের খবর।
শান্তিতে বিদায় নিন, লর্ড ট্যানাস, অযথা তর্ক করে মৃত্যুপথযাত্রীর সময় নষ্ট করার মানুষ নয় রাজপুত্র। এক পা এগিয়ে পিতার ঠোঁটে চুমো খায় সে। এরপর, একবারো পিছনে ফিরে না তাকিয়ে নীল তলোয়ার হাতে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়।
বিজয়ের পথে যাও, পুত্র, ফিসফিসিয়ে বললো ট্যানাস। মুখ কাত করে একভাবে তাকিয়ে রইলো পাশের দেয়ালে। বিছানায়, ওর পায়ের কাছে বসে মূর্তির মতো নোংরা মেঝের দিকে চেয়ে রইলাম আমি, ট্যানাসের মতো কাউকে কাঁদতে দেখা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
*
শিলুকদের ঢাকের শব্দে ঘুম ভাঙলো আমার। চারিদিকে আঁধার ঘনিয়েছে ততক্ষণে।
নিচু হয়ে এসেছে প্রদীপের শিখা, বিছানার পাশে এখন দপদপ করে জ্বলছে ওটা। শকুনের ডানা ঝাঁপটানোর মতো ভূতুড়ে ছায়া
ফেলছে কক্ষের ছাদে। ধীরে ট্যানাসের শায়িত দেহের দিকে এগুলাম। জানি, ভুল হয় নি শিলুকদের, এসব ব্যাপারে ভুল করে না তারা। মৃত্যু-শোক পালন করছে ঢাকের শব্দ।
ঠিক যেমন দেখেছিলাম, দেয়ালের দিকে মুখ কাত করে শুয়ে আছে ট্যানাস। কাঁধে হাত দিতেই মৃত্যুর শীতল স্পর্শ লাগলোঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার শরীর।
সারারাত তার পাশে বসে থেকে শোক পালন করলাম আমি, শিলুকদের মতোই।
সকালে খবর পাঠালাম শবদেহ প্রস্তুতকারীদের।
ওই কসাইগুলো আমার বন্ধুর অঙ্গ-প্রতঙ্গ কেটে ফেলুক এ আমি হতে দিই নি। ট্যানাসের শরীরের বাম পাশ দিয়ে লম্বা করে কাটলাম। এ কসাইয়ের পোচ নয়, দক্ষ শল্যবিদের নিখুঁত কাটা।
ওই কাটা পথে টেনে বের করে এনেছিলাম তার দেহের অভ্যন্তরের অঙ্গ। ট্যানাসের হৃৎপিণ্ড হাতে নিয়ে আবেগে কেঁপেছিলাম । যেনো ওর অমানুষিক শক্তি আর তারুণ্যের কথা অনুভব করছিলাম রক্ত-মাংসের সেই বস্তু হাতে নিয়ে। ওটার বদলে ভালোবাসায় ভরে দিলাম নিহত বীরের বুকের খাঁচা। দেহের একপাশের কাটা এবং বুকের ক্ষতটা বুজিয়ে দিলাম ভালো করে।
এরপর, তামার চামচ নিয়ে ওর নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে শেষমাথা পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। যখন আর এগুতে চাইলো না ওটা, এক ধাক্কায় ভেঙ্গে ফেললাম বাধা প্রদানকারী হাড়। এরপর, সেই পথে ধীরে চামচে আঁচড়ে বের করে আনলাম নরম থকথকে মস্তিষ্ক। কেবলমাত্র তখনি শবদেহপ্রস্তুকারীরা অনুমতি পেলো ওর কাছে আসার ।
আর কিছুই করার ছিলো না বন্ধুর জন্যে। তবুও আদবার সেজেদ-এর সেই বিষণ্ণ দুর্গে মমি-করবার চল্লিশ দিবস-রজনীতে আমি ট্যানাসের সঙ্গেই রইলাম। এখন বুঝি, ওটা ছিলো দুর্বলতা। ট্যানাসের মৃতু-সংবাদে আমার কর্ত্রীর শোক সহ্য করা সম্ভব ছিলো না আমার পক্ষে। সেই দায়িত্ব মেমননের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলাম। মৃতের সাথে লুকিয়ে ছিলাম আমি, অথচ জীবিত মানুষদের আমাকে প্রয়োজন ছিলো বেশি। সব সময়ই কাপুরুষ ছিলাম আমি।
ট্যানাসের মমিকৃত দেহ ধারণ করার জন্যে কোনো কফিন নেই। কেবুই-এ পৌঁছুলে আমি নিজ হাতে তৈরি করে দেবো একটা। এর মধ্যে ইথিওপিও মহিলারা সেলাই করে লম্বা থলে তৈরি করলো মৃতদেহ বহনের জন্যে।
*
পর্বতের উপর থেকে ওকে নামিয়ে নিয়ে এলাম আমরা। শুকিয়ে আসা হালকা শরীরের ওজন সহজেই বহন করলো তার শিলুকেরা। এই সম্মান পাওয়ার জন্যে নিজেদের মধ্যে লড়লো তারা। বাঁকানো পথে, পর্বত পেরিয়ে এগিয়ে চলা যাত্রাপথে থেকে থেকে শোকসংহগীত গাইলো শিলুকেরা। অন্যান্য সময়ে, ট্যানাসের শেখানো নীল বাহিনীর রণ-সংগীত গাইলো। সারাটা পথ ট্যানাসকে বহনকারী থলের পাশে পাশে হেঁটেছিলাম আমি। বৃষ্টি নেমে এলো। ভিজে একশা হয়ে গেলাম আমরা। প্রবল স্রোতস্বিনী নদী দড়ি ধরে সাঁতরে পার হতে হলো আমাদের । রাতে আমার বিছানার পাশেই থাকলো ট্যানাসও। জোরে জোরে প্রশ্ন করে নিজের সাথেই কথা বোলতাম আমি, যেনো মৃত্যুর ওপার থেকে ফিরে এসে আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে ট্যানাস।
অবশেষে, শেষ খাড়াই বেয়ে সমতলে নেমে এলাম আমরা। কেবুই-এর দিকে এগুতে দেখলাম, এগিয়ে আসছে আমার মিসট্রেস। মেমনরে পাশে, রথের পাদানীতে দাঁড়িয়ে আছে সে।
ঘেসো জমির উপর দিয়ে আমাদের কাছে চলে আসতে, বিশাল জিরাফ একাশিয়া গাছের ছায়ায় ট্যানাসের মরদেহ নামিয়ে রাখার নির্দেশ দিলাম শিলুকদের। রথ থেকে নেমে ধীরে এগুলো আমার কর্ত্রী । এক হাত কফিনের উপর রেখে মাথা নিচু করে সম্মান জানালো সে নীরবে।
শোক তার উপর কী প্রভাব ফেলেছে, দেখে হতবাক হয়ে গেলাম । চুলে পাক ধরে গেছে লসট্রিসের, চোখে নিদারুন বেদনা। সবসময়ের ঔজ্জ্বল্য আর নেই অবয়বে। বুঝলাম, অসাধারণ সৌন্দর্য আর তারুণ্য চিরদিনের মতো বিদায় নিয়েছে লসট্রিসের কাছ থেকে। নিঃসঙ্গতা ঘিরে আছে ঘন মেঘের মতোন। কিন্তু এখনো যথেষ্ট সাহসী রানি, কেউ বুঝবে না মাত্রই বিধবা হয়েছে সে।