অনায়াসে আমাকে ভীড়ের মধ্য থেকে আলাদা করে ফেললেন তিনি। বুনো চিতার মতো হলদে চোখে তাকালেন আমার দিকে, সামান্য ঝাঁকালেন মাথা। ধীরে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম, প্রতিবারের মতোই বিস্মিত হলাম তাঁর উচচতা আর কাঁধের বিস্তারে। লম্বা, সুগঠিত হাত-পা, শক্ত মেদহীন পেটের একজন দারুন সুদর্শন মানুষ আমার মনিব। সিংহের মতো গর্বোদ্ধত মস্তক, ঘন চুলের অরণ্য মাথায়। তখন চল্লিশ বছর মতো ছিলো তাঁর বয়স, বিশ বছর ধরেই আমি তার দাস।
বাগানের কেন্দ্রে অবস্থিত বারাজ্জার উদ্দেশ্যে চললো সভা, চারদিকে কোনো দেয়াল নেই স্থাপনাটির, মাথার উপরে পাতার আচ্ছাদন; নদী থেকে বয়ে আসা স্নিগ্ধ বাতাস শরীর জুরায়। নিচু টেবিলের উপর পা ভাজ করে বসেন ইনটেফ, তার পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে রাজ্যের কার্যাবলি সম্বলিত স্ক্রোলগুলো। সবসময়ের মতো আমি বসলাম তার পেছনে। দিনের কার্যসূচি শুরু হলো।
সেই সকালে দুইবার ইনটেক মাথা সামান্য হেলিয়ে আমার দিকে ফিরিয়েছিলেন। ঘাড় ফেরান নি, এমনকি একটি শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেন নি, কিন্তু আমি জানি, আমার পরামর্শ চেয়েছিলেন তিনি। ঠোর্ট প্রায় না নড়িয়ে, এতো নিচু স্বরে কথা বললাম আমি; কেউ সেভাবে বুঝতেই পারে নি কিছু বলেছি তাকে।
একবার বিড়বিড় করে বললাম, ও মিছে বলছে, আর দ্বিতীয়বার, এই পদের জন্যে রেতিক যোগ্য লোক, আর তাছাড়া আমার মালিকের ব্যক্তিগত কোষাগারে পাঁচটি স্বর্ণের আংটি উপহার হিসেবে দিতে চেয়েছে সে। যে কথাটা বলি নি, তা হলো, কাজ হয়ে গেলে বাকি আর একটি আংটি আমাকে উপহার দেবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে সে।
দুপুর নাগাদ রাজকীয় সভা সমাপ্তি ঘোষণা করে খেতে চাইলেন ইনটেফ। প্রথমবারের মতো একা হলাম আমরা দুজন, কেবল মাত্র প্রাসাদের প্রধান রক্ষী এবং প্রধান জল্লাদ র্যাসফার ছাড়া। বারাজ্জার দৃষ্টিপথের বাইরে, দূরে দরোজায় অবস্থান নিল সে।
ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন ইনটেফ, তাঁর সামনে রাখা সুস্বাদু মাংস আর ফলমূলের থেকে খেতে বললেন। আমার উপর সম্ভাব্য বিষক্রিয়ার প্রভাবের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে সেদিন সকালের রাজকার্য নিয়ে আলোচনা চালিয়ে গেলাম আমরা।
এরপরে হাপির হ্রদে আমাদের অভিযান এবং জলহস্তি শিকার সম্বন্ধে জানতে চাইলেন ইনটেফ। সবকিছু বর্ণনা করে গেলাম আমি; জলহস্তির মাংস, চামড়া আর দাঁত থেকে কি পরিমাণ লাভ হতে পারে, তার একটা ধারণাও দিলাম। সম্ভাব্য লাভের পরিমাণটা একটু বাড়িয়ে বলতেই হাসি ফুটল আমার মালিকের মুখে। প্রাণখোলা, মনমুগ্ধকর তার হাসি। এ থেকে কিছুটা অনুমান করা যায় ইনটেফের মানুষ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। এমনকি আমি পর্যন্ত বোকা বনেছিলাম অন্তত একবার ।
জলহস্তির মাংসের তৈরি রান্নায় ইনটেফ মগ্ন হতেই, সাহস সঞ্চয় করে বলতে শুরু করলাম আমি। আমার মালিক তো জেনে গেছেন, অভিযানে আপনার কন্যাকে সাথে নেয়ার অনুমতি দিয়েছিলাম আমি। তার চোখের দৃষ্টি বলে দিল, এ তার জানা ছিলো; দেখছিলেন আমি ব্যাপারটা আড়াল করতে চাই কি না।
আমার অনুমতি নেওয়া দরকার বলে মনে হয় নি তোমার? মৃদুকণ্ঠে বললেন ইনটেফ, তার চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে একটা আঙুর ছিঁড়তে লাগলাম আমি। আমরা রওনা হওয়ার ঠিক আগে যেতে চেয়েছে লসট্রিস। আপনি তো জানেন, দেবী হাপি তার রক্ষক, তাই তাঁর মন্দিরে পূজো দিতে চেয়েছে সে।
তাও আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হয় নি? আবার বললেন ইনটেফ, আঙুরটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম আমি। ঠোঁট ফাঁক করে ওটা মুখের ভেতরে যেতে দিলেন তিনি। এর অর্থ হচ্ছে, এখনও আমার উপর ততটা বিরাগ নন, অতি অবশ্যই ট্যানাস এবং লসট্রিস সম্পর্কিত সত্যিটা তার কাছে পৌঁছে নি।
আসূনের সম্রাটের সঙ্গে সভায় ব্যস্ত ছিলেন আপনি সেই সময়ে। বিরক্ত করার সাহস করি নি। আর তাছাড়া, এতে কোনো ক্ষতি ছিলো না। সাধারণ একটা সিদ্ধান্ত, মালিকের পক্ষ থেকে মাঝে-মধ্যেই নিই আমি।
কী সহজ তুমি, তাই না, আমার প্রিয় টাইটা? মুচকি হাসলেন ইনটেফ। আর সুন্দরও বটে। চোখের পাতায় যে রঙ করেছ, ভালো লাগছে আমার। আর কি সুগন্ধি লাগিয়েছ শরীরে?
বুনো ভায়োলেটের পাঁপড়ির নির্যাস, উত্তরে বললাম। আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমি আনন্দিত। এক পাত্র উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছি আমি। আমার থলের ভেতর থেকে পাত্রটা বের করে কুর্নিশ করে তার পদতলে রাখলাম আমি ওটা। আমার চিবুকের নিচে এক আঙুল রেখে মুখ উঁচু করলেন ইনটেফ, চুমো খেলেন ঠোঁটে । বাধ্যগতের মতো আমি প্রত্যুত্তর করলাম তাঁর চুম্বনের, শেষে ঠোঁট সরিয়ে গালে হালকা করে আদর করে দিলেন ইনটেফ।
যা কিছু কর না কেন, তুমি এখনও অনেক আকর্ষণীয়, টাইটা। এতো বছর পরেও আমাকে আনন্দ দিতে পার তুমি। এখন বলো তো, লসট্রিসের খেয়াল নাও ঠিকমতো? এক মুহূর্তের জন্যেও তোমার দৃষ্টিসীমার বাইরে বা যত্নের বাইরে থাকে সে?
না, মালিক। সজাগ আমি বললাম ।
তো, ওর ব্যাপারে আলাদা করে কোনো কিছু বলতে চাও না আমাকে? আছে নাকি তেমন কিছু?
তখনও হাঁটুর উপরে দাঁড়িয়ে আমি, কথা সরছিল না মুখে। শুকিয়ে গেছে গলা।
আমার সামনে ঢোক গিলো না, প্রিয়, হাসলেন ইনটেফ। পুরুষ মানুষের মতো কথা বল, যদিও তুমি তা নও। নিষ্ঠুর একটা কৌতুক এটা, দারুন বাজল আমার বুকে।