শরবিদ্ধ কোয়েলের মতো ছটফট করে এই প্রাণ
যখন প্রিয়তমের মুখখানি দেখি
আর আমার কপোলে লালিমা জাগায়
তার সেই হাসি–
নৌকার পেছন থেকে আর একটি কন্ঠস্বর যোগ দেয় আমাদের ঐকতানে। একজন পুরুষের গলা। গম্ভির, শক্তিশালী–আমার স্বরের স্বচ্ছতা বা শুদ্ধতা তাতে নেই। আমারটা যদি হয় সকালের ঘুমভাঙানি পাখির, তো এরটা তরুণ সিংহের।
মুখ ফিরিয়ে হাসলো লসট্রিস, নীল নদে সূর্যকিরণ জাগল যেন। যার জন্যে এই হাসি, সে যদিও আমার বন্ধু; বলা ভালো, পৃথিবীতে আমার একমাত্র সত্যিকারের বন্ধু–বুকের গভীরে ঈর্ষার জ্বলুনি ঠিকই টের পেলাম। তবুও, ট্যানাসের দিকে ফিরে জোর করে হাসলাম আমিও, যার উদ্দেশ্যে ভালোবাসার হাসি হাসছে লসট্রিস।
ট্যানাসের বাবা পিয়াংকি, প্রভু হেরাব ছিলেন মিশরের অন্যতম রাজকীয় সভাষদ; তবে তার মা ছিলেন মুক্ত এক তেহেনু দাসের কন্যা। ট্যানাসের বালক বয়সে জলাভূমির জ্বরে মারা যায় তার মা, তবে লোকমুখে শুনেছি মিশরের দুই সাম্রাজ্যে তার মতো রূপসী পাওয়া ছিলো ভার।
ট্যানাসের বাবাকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনতাম। বেশ ভালো মনের মানুষ ছিলেন, প্রায় ফারাওয়ের সম-পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকা অবস্থাতেই সবকিছু হারিয়েছিলেন। যতোটা না সৌন্দর্য ছিলো, তার চেয়ে বেশি শক্তিমত্তা ছিলো তার। আর মনটা ছিলো একেবারে সাদা। হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই উদার ছিলেন। তাই নিজ বন্ধুদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে ফারাওয়ের সু-নজর হারিয়েছিলেন।
বিপুল ধন-সম্পদ ছাড়া বাবা-মার সব ভালো দিকগুলো পেয়েছে ট্যানাস। শক্তি মত্তায় বাপের মতো, সৌন্দর্যে ঠিক যেনো মা। তো, আমার কর্ত্রী যদি তাকে ভালবাসে, অনুতাপ করার কী আছে আমার? আমিও তাকে ভালোবাসি মনের গভীরে ঠিকই জানি, দেবতারা যদি হঠাৎ করে ক্রীতদাসের নিচু বর্ণ থেকে আমার মর্যাদা বাড়িয়েও দেন; ওকে আমি পাবো না কোনো দিনও। নপুংসক যে আমি। এরপরেও, মানবাত্মার স্বভাবই এমন, অসম্ভবের সুখ-স্বপ্ন আমার ভেতরটা তোলপাড় করে ফেলে।
পায়ের কাছে দুটো মিশমিশে কালো দাসী মেয়েকে নিয়ে গলুইয়ের কাছে বসেছে লসট্রিস। কুশ দেশের মেয়ে ও দুটো আস্ত বজ্জাত গলার চারপাশে সোনার কলার ছাড়া উদোম গা। লসট্রস নিজেও পরিশুদ্ধ লিনেনের একটা আঁটো জামা পরে আছে কেবল, ঝকঝকে সাদা রঙ ওটারঠিক যেনো সারসের পাখার মতো। ওর শরীরে উপরিভাগের বর্ণ তেল দেওয়া সিডারের মতো রোদে পোড়া, বিব্লসের ওপারের পর্বতে জন্মায় গাছগুলো। বুক জোড়ার আকৃতি ডুমুরের মতো, ডালিম দানার মতো লালচে হয়ে আছে বৃন্ত দুটো।
রাজকীয় পরচুলা একপাশ সরিয়ে রেখেছে সে। চুলগুলো একপাশে টেনে বেণী করেছে, মোটা বাদামী দড়ির মতো একটা বুকের উপর পরে আছে সেটা। ওর চোখের জাদুকে আরো মোহনীয় করেছে উপরের পাতায় ছোঁয়ানো নীলচে-সবুজ প্রসাধনী। লসট্রিসের চোখের রঙও অবশ্য সবুজ, শুকনো মরশুমের নীল নদের জলের মতো স্বচ্ছ। দুই বুকের মাঝখানে স্বর্ণ আর ল্যাপিস লাজুলিতে কারুকার্য করা নীল-নদের দেবী হাপির অবয়বের হার পরে আছে লসট্রিস। অসাধারণ একটা শিল্পকর্ম ওটা, নিজ হাতে ওরই জন্যে তৈরি করেছি আমি।
হঠাৎই মুঠো করা হাত মাথার উপরে তুলে ধরে ট্যানাস। একইসঙ্গে দাঁড় টানা থামিয়ে নিজেদের বৈঠা উঁচু করে পানির উপর ধরে রাখে দাড়ীরা, সূর্যালোক ঝিকমিক করছে তাদের দাঁড়ের ডগা থেকে ঝরে পড়া রূপালি পানিতে। এরপরে হাল ঘুরিয়ে দেয় ট্যানাস; ওপাশের দাঁড়ীরা পেছন দিকে বাইতে থাকে। সবুজ পানিতে তোলপাড় তুলছে বৈঠার আঘাত। এ পাশের দাঁড়ীরা সামনে টানতে লাগলো প্রাণপণে। এতো দ্রুত ঘুরে গেলো নৌকার নাক, বিপদজনক ভঙিতে কাত হয়ে গেলো ওটা। কিন্তু এরপরেই সামনে ছুটলো। চোখা গলুই, দেবতা হোরাসের নীল চক্ষু অঙ্কিত; ঘন প্যাপিরাস ঝোঁপের উপর দিয়ে হিঁচড়ে নদীর মূল স্রোতধারা ছেড়ে শান্ত পানির ছোটো একটা হ্রদে পড়লো।
গান থামিয়ে, চোখের উপরটা হাত দিয়ে আড়াল করে সামনে তাকাল লসট্রিস। ওই তো! চিৎকার করে উঠলো সে, ছোট্ট-কমনীয় হাত দিয়ে সামনে দেখাচ্ছে ।হ্রদের দক্ষিণ প্রান্ত পুরো ঘিরে রেখেছে ট্যানাসের নৌবহরের অন্যান্য জলযান; মূল নদীর প্রবেশ মুখ আটকে রেখেছে।
স্বাভাবিকভাবেই উত্তরে অবস্থান নিয়েছে ট্যানাস; তার জানা আছে, এখানটাতেই হিংস্র শিকারের দেখা মিলবে বেশি। আমি প্রার্থনা করছিলাম, তা যেনো না হয়। এমন নয় যে আমি একজন কাপুরুষ; তবে কি না আমার কর্ত্রীর নিরাপত্তার কথাও তো । ভাবতে হয় আমাকে! বেশ ষড়যন্ত্র করেই হোরাসের প্রশ্বাস নৌকায় অবস্থান করে নিয়েছে সে, প্রতিবারের মতোই এবারেও এতে আমার বেশ বড় একটা ভূমিকা ছিলো। ওর বাবা যদি টের পায় শিকারে এসেছে লসট্রিস, যা তিনি পাবেনই, সেক্ষেত্রে আমার অবস্থা বেগতিক হতে পারে। আর যদি এটা জানতে পারেন, হোরাসের প্রশ্বাসে পুরো একদিন ট্যানাসের সংস্পর্শে ছিলো লসট্রিস; এমনকি আমার প্রতি তার সদয় স্নেহও বাঁচাতে পারবে না আমাকে। তরুণ ট্যানাসের সম্পর্কে তাঁর নির্দেশ নিয়ে ভুল করার কোনো অবকাশ নেই।
হোরাসের প্রশ্বাসে এই মুহূর্তে সম্ভবত আমি একমাত্র প্রাণী, যে কি না শিকার নিয়ে উত্তেজিত নই। বাকিরা রীতিমতো টগবগ করে ফুটছে। হাতের ঝাঁপটায় ইশারা করলো ট্যানাস, ধীরে স্থির হলো নৌকা। হ্রদের সবুজ পানিতে অল্প অল্প দুলছে ওটা। এতো স্বচ্ছ, শান্ত পানি উঁকি মেরে নিজের অবয়ব দেখলাম আমি তাতে। প্রতিবারের মতোই নিজের সৌন্দর্যে অবাক হতে হলো, নীলপদ্মের চেয়েও যেনো কমনীয় আমার মুখাবয়ব। নৌকার উপরের ব্যস্ততা আমার নিজ-সৌন্দর্য উপভোগে ছেদ টানলো।