ধীরে, সতর্কভাবে ওর বুকের আচ্ছাদনের ফিতেগুলো খুলে ওটা ছাড়িয়ে আনলাম আমি। আমরা দু জনেই তাকিয়ে দেখছি ক্ষতটা। ঠিক নীল তলোয়ারের ফলার মাপে ভেতরে ঢুকে গেছে ক্ষত; রক্তাক্ত-ভেঁজা মুখ ওটার। ট্যানাসের প্রতিটি প্রশ্বাসের সঙ্গে বাষ্পের বুদবুদ উঠছে সেখান থেকে। নিজের কাছেও স্বীকার করতে চাইছিলাম না–ফুসফুঁসের আঘাত ওটা। ফুসফুঁসে সেঁধিয়ে যাওয়া তলোয়ারের আঘাত থেকে কোনো মানুষ বেঁচে ফিরতে পারে না।
তুমি আঘাত পেয়েছে, বোকার মতো হলো কথাগুলো। ট্যানাসের মুখে তাকাতে পারলাম না আমি।
না, বুড়ো বন্ধু। আমি আঘাত পাই নি, নরমস্বরে প্রত্যুত্তর করে ট্যানাস। আমি মারা গেছি হে।
*
ট্যানাসের শিলুকেরা একটা ডুলা তৈরি করলো তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। ধীরে, সতর্কতার সাথে তাকে কাঁধে নিয়ে আবার সেজেদ-এর দুর্গ অভিমুখে চললো তারা।
রাজা আরকুনের বিছানায় ওকে শুইয়ে দিয়ে সবাইকে তাড়িয়ে দিলাম আমি। একা হতে, বিছানার পাশে সাজিয়ে রাখলাম নীল সেই তলোয়ার। একটু হেসে, আলতো করে ওটার ফলায় হাত বুলিয়ে দিলো ট্যানাস। এর জন্যে চরম মূল্যই দিতে হচ্ছে আমাকে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো সে, একবার যদি ওটা হাতে যুদ্ধের ময়দানে যেতে পারতাম!
কোনো আশার বাণী শোনানো বৃথা এখন। অভিজ্ঞ যোদ্ধা ট্যানাস–বহু লড়াইয়ে এ রকম ফুসফুঁসের আঘাত দেখেছে সে। বাজে কথা বলে ওকে ভুলাতে পারবো না আমি। উল আর লিনেন কাপড়ের পট্টি বেঁধে দিলাম ক্ষতে। ওটা বাঁধতে বাঁধতে রক্তপাথ বন্ধের মন্ত্র জপছিলাম, দূরে সরে থাকো, সেথ-এর ঘৃন্য সৃষ্টি ।
কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছিলো ট্যানাস। প্রতিটি শ্বাস বহু কষ্টে নিতে হোচ্ছিলো তাকে। বুকের ভেতরে রক্তের গর্জন শুনতে পাচ্ছিলাম আমি।
কিছুটা ঘুমোনোর জন্যে মিশ্রণ দিতেই ওটা খেতে অস্বীকৃতি জানালো মিশরীয় সমরনায়ক। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বেঁচে থাকতে চাই আমি। শেষ পর্যন্ত।
কী করতে পারি তোমার জন্যে?
অনেক তো করেছো, বললো সে। তোমার কাছে আমাদের দাবি যে শেষ হওয়ার নয়।
মাথা নাড়লাম আমি। তোমাদেরও চিরকাল সেবা করে যেতে চাই।
ঠিক আছে, শেষবারের মতো কিছু চাইছি। প্রথমত, কখনো মেমননকে তুমি জানতে দেবে না, আমি তার প্রকৃত পিতা। ও যেনো সব সময় মনে করে, ফারাও-এর রক্ত বইছে তার দেহে। নিয়তির খেলায় অনেক শক্তি প্রয়োজন ওর।
রাজার চেয়ে তোমার রক্ত বহন করতে এতোটুকু অপমান হবে না তার।
প্রতিজ্ঞা করো–ওকে বোলবে না এটা?
প্রতিজ্ঞা করছি, আমি বললাম। বড়ো করে স্বস্তির শ্বাস ফেললো ট্যানাস।
আরো একটা দাবি আছে।
বলার আগেই ধরে নাও, ওটা পূরণ হয়ে গেছে। বললাম।
ওর যত্ন নিও কোনোদিনও আমার স্ত্রী হতে পারলো না যে। এতকাল ধরে যা করে এসেছে বিপদে-আপদে ওকে সঙ্গ দিও।
তুমি জানো, তা করবো আমি।
জানি। আমার মতোই ওকে ভালোবাসতে তুমি। লসট্রিস আর আমার সন্তানদেরও দেখে রেখো। সবাইকে যে তোমার হাতে দিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই আমার কাছে।
চোখ বন্ধ করলো ট্যানাস। আমি ভাবলাম, সময় এসে গেছে; কিন্তু যে কোনো মানুষের চেয়ে অনেক বেশি ছিলো তার প্রাণশক্তি। কিছু সময় পর, আবারো চোখ খুললো সে।
রাজপুত্রকে একবার দেখতে চাই।
চাতালে, তোমার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। দরোজার কাছে গিয়ে পর্দা তুলে ধরলাম আমি। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলো মেমনন এবং মাসারা। নিচু স্বরে কিছু একটা বলছিলো তারা। আমার আহ্বানে তড়িঘরি ছুটে এলো মেমনন। মেয়েটাকে একা রেখে সরাসরি ট্যানাসের বিছানার কাছে এসে তাকিয়ে দেখলো ওকে। বহুকষ্টে ঠোঁটে হাসি ফোঁটালো ট্যানাস।
সম্মানিত রাজপুত্র, যুদ্ধের সমস্ত জ্ঞান আমি তোমাকে শিক্ষা দিয়েছি, কিন্তু জীবন সম্পর্কে শেখাতে পারিনি। সেটা প্রত্যেক মানুষকে নিজে থেকে শিখে নিতে হয়। নতুন যে যাত্রায় চলেছি আমি, তার আগে একটা বিষয় ব লে যেতে চাই, তোমাকে সেবা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
একজন শিক্ষকের চেয়ে অনেক বেশি কিছু ছিলে তুমি আমার কাছে। মৃদুস্বরে বলে মেমনন। তুমি ছিলে আমার-না-চেনা পিতার মতো।
চোখ মুদলো ট্যানাস। যন্ত্রণায় বেঁকে গেছে মুখ।
একটু এগিয়ে, ওর হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নিলো রাজপুত্র। যন্ত্রণা হলো আরো একটি শক্রর মতো মুখোমুখি যার সামনা করতে হয়। তুমি ওটা আমাকে শিখিয়েছিলে লর্ড ট্যানাস, সে ভেবেছে ক্ষতের ব্যথায় অমন মুখাবয়ব করেছে। ট্যানাস। আমি জানি, মূলত পিতা শব্দটিই কষ্ট দিয়েছে ট্যানাসকে।
চোখ খুললো সে। ধন্যবাদ, যুবরাজ। শেষ এই যে যন্ত্রণা, এতে তুমি আমার সঙ্গে থাকায় ভালো লাগছে।
বন্ধু বলো আমাকে যুবরাজ নয়। ট্যানাসের হাত ধরে রেখেই বিছানার পাশে হাঁটু-গেড়ে বসলো মেমনন।
তোমার জন্যে একটা উপহার আছে, বন্ধু, ফুসফুঁসে জমতে থাকা রক্ত ট্যানাসের স্বর রুদ্ধ করে ফেলেছে। বিছানার পাশেই রাখা তলোয়ারটার হাতল ধরলো সে, কিন্তু ওটা তোলার শক্তি নেই শরীরে।
মেমননের হাত নিজের বাহু থেকে সরিয়ে, তলোয়ারের হাতলের উপর রাখলো ট্যানাস। এটা আজ থেকে তোমার, ফিসফিস করে কথা ক টা উচ্চারণ করলো ও।
যখনই খাপ থেকে খুলবো এটা তোমাকে মনে করবো আমি। যতোবার রণক্ষেত্রে ব্যবহার করবো, তোমার নাম উচ্চারণ করবে লর্ড ট্যানাস। কারুকাজ করা তলোয়ারটা হাতে তুলে নেয় রাজকুমার।