এরপরেই, স্বস্তির সাথে শুনলাম, প্রাসাদের প্রধান রক্ষী, র্যাসফার চিৎকার করে দশ বছর বয়সী এক বেদুঈন দাস বালককে ডাকছে; এ মুহূর্তে আমার মালিকের প্রথম পছন্দ। কিছু সময়ে পরেই আমার দরোজার সামনে দিয়ে আতঙ্কে বিবশ ছেলেটাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চললো র্যাসফার; পর্দার আড়ালে উজিরের ব্যক্তিগত প্রকোষ্ঠে। অনেক, অনেকবার শুনেছি; তবুও কেন যেনো শিশুদের আর্ত চিৎকার সহ্য হয় না আমার। করুণায় মন ভরে গেলো। তবে, অন্তত এও স্বস্তির, যে আমাকে ডেকে পাঠানো হয় নি। রাতে ভালো ঘুম প্রয়োজন, সকালে পরিচ্ছন্ন অবস্থায় মোকাবেলা করতে হবে আমার মনিবকে।
ভারী মন নিয়ে সকালের সূর্য উঠার আগেই ঘুম ভাঙল। প্রতিদিনের মতো নীলের বরফ ঠাণ্ডা পানিতে স্নানও কোনো পরিবর্তন আনল না। দ্রুত নিজের প্রকোষ্ঠে ফিরে গেলাম; ওখানে দুই দাস ছেলে আমার শরীরে তেল মেখে, চুল আঁচড়ে দিতে লাগল। রাজপরিবারে প্রসাধনী ব্যবহারের যে প্রচলন, আমি তার বিরুদ্ধে। আমার দেহের বর্ণ বা চামড়ার যে উজ্জ্বলতা, তাতে এসবের কোনো প্রয়োজন নেই; কিন্তু আমার মনিব চান তার দাসেরা তা ব্যবহার করুক। আর আজকের দিনে তাকে সন্তুষ্ট করতেই হবে আমাকে।
তামার আয়নায় নিজের অবয়ব আশ্বস্ত করে আমাকে, কিন্তু খিদের অভাবে নাস্তা করতে পারলাম না। সভাসদদের মধ্যে সবার আগে আমিই পৌঁছলাম জলের বাগানে; প্রতিদিন সকালে ওখানেই বসে কাৰ্যসভা।
সভাসদের আগমনের অপেক্ষায় বসে মাছরাঙাদের কাজ দেখতে লাগলাম। জলের বাগানে যে ভবন তৈরি করা হয়েছে, তার ছক এবং নির্মাণ তদারকি আমি করেছি। বেশ কটি খাল এবং হ্রদের এক অপূর্ব সমন্বয় এটি, একটি থেকে অপরটিতে প্রবাহিত হয় জল। রাজ্যের প্রতিটি অংশ থেকে, এমনকি রাজ্যের বাইরে থেকেও নিয়ে আসা হয়েছে ফুল গাছ, কী অদ্ভুত বর্ণিল তাদের রঙ। নীল নদে যত প্রকারের মাছ আছে, তার সবই পাওয়া যাবে জল-বাগানের হ্রদে। তবে মাছরাঙাদের কারণে প্রতিনিয়তই নতুন করে জোগান দিতে হয় ওগুলো।
ল্যাপিস-লাজুলি পাথরের মতোই মুক্ত আকাশে পাখি ওড়া দেখতে পছন্দ করেন আমার মনিব, ইনটেফ; তারপর এক ঝলকে নিচে নেমে ছোঁ মেরে যখন ওরা লম্বা ঠোঁটে তুলে নেয় ছটফটে রুপালি শিকার তাঁর আনন্দ আর ধরে না। আমার মনে হয়, নিজেকে ওদের মতোই পরভোজী ভাবেন তিনি, মানুষ-শিকারী নিজেকে মনে করেন পাখির সখা। কখনওই পাখিদের বিরক্ত করা পছন্দ করেন না তিনি, মালীদের নিষেধ করা আছে এ ব্যাপারে।
ধীরে ভরে উঠছে সভা-প্রাঙ্গন। বেশিরভাগই এখনও ঘুমের আতিশায্যে লম্বা হাই তুলছে। আমার মনিব, ইনটেফ সাত সকালে ঘুম ভেঙে উঠেন, রৌদ্র চড়ার আগেই প্রাসাদের প্রাত্যহিক কাজ-কর্ম শেষ করে ফেলতে ভালবাসেন। সকালের প্রথম সূর্য। রশ্মিতে ভিজে তার আগমনের অপেক্ষায় বসে থাকি আমরা।
আজ মালিকের মন ভালো, ফিসফিস করে বলে রাজপরিচর্যক, আমার পাশেই আসন নেয় সে। আশার ছোটো একটা আলো যেনো দেখতে পেলাম আমি। লসট্রিসকে করা আমার অযাচিত প্রতিজ্ঞার ফলাফল হয়তো অত খারাপ নাও হতে পারে।
প্যাপিরাসের ঝারে কাঁপন তুলে বয়ে যায় নদী থেকে আসা বাতাস, ইনটেফের আগমনে গুঞ্জন উঠে সভাসদদের মধ্যে।
রাজকীয় তার হাটার ধরন, সম্মান আর ক্ষমতার বিচ্ছুরণ তাতে স্পষ্ট। গলার চারধারে প্রশংসার স্বর্ণ-শেকল পরে আছেন তিনি; খনি থেকে সংগ্রহীত লাল সোনার একটা হার ওটা, স্বয়ং ফারাও পরিয়ে দিয়েছেন তাকে নিজ হাতে। ইনটেফের আগে আগে হাঁটছে তাঁর বাণী-বন্দনাকারী, বাঁকা পায়ের এক বামন; তীক্ষ্ণ গলায়, নাকী সুরে গাইছে। সুন্দরই হোক বা কিম্ভুতকিমাকার, কৌতূহল উদ্দিপক সৃষ্টিতে নিজের চারপাশ ভরে রাখতে ভালবাসেন আমার মনিব।
জাগো, মিশরের জনতা! নীল নদীর জলের অভিভাবককে সেলাম জানাও! মহান ফারাওয়ের সতীর্থের সামনে নিচু হও! এ সমস্তই ইনটফকে দেওয়া রাজার অভিধা, প্রতিটি বিশেষ বিশেষ দায়িত্বভার ন্যস্ত করেছে তার উপর। যেমন, নীল নদির জলের অভিভাবক হিসেবে প্রতি মৌসুমেই বন্যা এবং পানির উপরিতলের গভীরতা জানতে হয় তাকে; বলাবাহুল্য, তার হয়ে সেই দায়িত্ব পালন করে চলেছে বিশ্বস্ত ছোটলোক কৃতদাস টাইটা।
অর্ধেক বছর ধরে প্রকৌশলী আর গণিতজ্ঞদের নিয়ে খেটেছি আমি, আসুয়ানের পাথুরে চূড়ার উচ্চতা মেপেছি যাতে করে বন্যার সময়ে পানির উচ্চতা নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা যায়। সেই হিসাব থেকে ফসল তোলার মৌসুমের আগাম ঘোষণা করা সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে, খরা এবং ভরা মৌসুমের পূর্বাভাস করাও যায় এ দেখে । আমার কাজে দারুন সন্তুষ্ট ফারাও আরও সম্মান এবং পুরস্কার দিয়েছেন আমার মালিক, ইনটেফকে।
কারনাকের সম্রাটের সামনে মাথা নত করুন, নেক্রোপলিসের প্রভু, রাজকীয় সমাধির রক্ষণাবেক্ষণকারীকে সেলাম! এই অভিধার বদৌলতে আমার মালিক বর্তমান ফারাও এবং পূর্ববর্তী সকল সম্রাটের মূর্তি তৈরি, প্রস্তুতি এবং পরিচর্যার দায়িত্ব পেয়েছেন। এবারেও, সমস্ত কাজের ভার ন্যস্ত হয়েছে বহু-ব্যবহারে ক্লান্ত ক্রীতদাসের কাঁধে। ওসিরিসের গেলো বছরের উৎসবের পর গতকালই কেবল ইনটেফ পরিদর্শন করেছেন নির্মাণাধীন রাজসমাধি। গরম আর ধুলোর মাঝে সব সময় আমিই গিয়েছি শ্রমিকদের কাজ তদারকিতে, রাজমিস্ত্রি আর প্রস্তরশিল্পীদের তাগিদ দিতে। মাঝে মধ্যে নিজের মতো গুণাবলির কথা মনিবকে জানতে দিয়েছি বলে আফসোস হয় বৈকি।