দাস বালকদের সংগ্রহশালায় আমি ছিলাম বয়োজ্যেষ্ঠ। অতীতের বহু দাসের ভাগ্যে যা ঘটেছে, বয়সের কারণে সৌন্দৰ্য্য কমে যাওয়ার কারণে মুক্ত বাজারে বিক্রি হয়ে যাওয়া, আমার ক্ষেত্রে সেটা ঘটে নি। কেবল শারীরিক সৌন্দৰ্য্য নয়, আমার অন্যান্য গুণের কদর করেন আমার মালিক। এমন নয় যে, আমার রূপ তিরোহিত হয়েছে, বরঞ্চ তা বেড়েছে, বয়সের সাথে সাথে আরো খুলেছে বলা যায়। ভাবতে পারেন, এ আমার অতিকথন; কিন্তু এই লিপিতে মিছে কিছু লিখবো না বলে প্রতিজ্ঞা করেছি আমি।
সাম্প্রতিক কালে আমার মালিক তার শারীরিক তুষ্টির জন্যে খুব বেশি ডাকেন না আমাকে, বলা যায়, তার এই অনাগ্রহের জন্যে সত্যি আমি আনন্দিত। যখন ওটা করেন তিনি, আমার জন্যে একটা শাস্তি ছাড়া আর কিছু নয় তা। ভালো করেই জানা আছে তাঁর, শারীরিক যন্ত্রণা আর অপমানবোধ কতটা প্রখর আমার। অবশ্য, সেই বালক বয়স থেকেই নিজের অনুভূতি আড়াল করে আনন্দের ধ্বনি আরোপ করতে শিখেছিলাম বিশেষ সময়ে; কিন্তু কখনই আমার মালিককে ধোকা দিতে পারি নি।
আশ্চৰ্য্য, আমার এই অনাগ্রহ কখনও তাঁর উপভোগে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। বরঞ্চ এতে করে আরো বেড়েছে তার আমোদ। ভদ্র তো ননই, একটু মায়াও নেই আমার মালিক, ইনটেফের। কত শত বার বিগত দিনগুলোয় ক্রন্দনরত বালক ছেলেগুলোকে পরিচর্যা করেছি আমার মালিকের ভালোবাসার পর, ইয়ত্তা নেই। যতোটা সম্ভব, মানসিক সহায়তা দিয়েছি ওদের। হয়তো এ কারণেই দাসদের প্রকোষ্ঠে ওরা আমাকে আকহ্-কা বা বড় ভাই বলে ডাকে।
এখন আর আমার মালিকের শয্যাসঙ্গী হয়তো নই, তবে অন্যান্য কারণে আমার কদর করেন তিনি। আমি আরো বিশেষ কিছু তাঁর কাছে কবিরাজ এবং শিল্পী, সুরকার এবং লিপিকার, স্থপতি এবং বই-পুস্তকের সগ্রাহক; উপদেষ্টা ও প্রকৌশলী-তার মেয়ের পরিচর্যাকারী। এতটা বোকা আমি নই যে, ভেবে বসব আমাকে তিনি বিশ্বাস করেন বা ভালবাসেন, তবে মাঝে-মধ্যে মনে হয় বেশ পছন্দ করেন তিনি আমাকে। এ কারণেই লসট্রিস এই গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছে আমার উপর।
বিবাহের ক্ষেত্রে ফায়দা লোটার ব্যাপার ছাড়া একমাত্র কন্যার আর কোনো কিছু নিয়ে মাথাব্যথা নেই ইনটেফের। ওই দায়িত্বটাও আমার উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। কখনও কখনও এমন হয়, নীল নদীর বছর পরিক্রমায় একবারও মেয়ের সাথে কথা হয় না ইনটেফের । তার প্রশিক্ষণ বা অধ্যয়ন সম্পর্কিত আমার প্রতিবেদনও মনোযোগ দিয়ে শোনেন না কখনও।
লসট্রিসের প্রতি আমার সত্যিকারের অনুভূতি তার কাছে সযত্নে আড়াল করে রাখি আমি। জানি, প্রথম সুযোগে আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে সেটা। সবসময় ভাব করি, যেনো লসট্রিসের পড়াশোনা বা পরিচর্যা আমার জন্যে বিরক্তিকর একটা কাজ, সুযোগ পেলেই বাদ দেব। নারীদেহের প্রতি আমার মালিকের মতোই অভক্তি আছে। আমার, সময়ে সময়ে এমনও বলে থাকি। আমার ধারণা, এমনকি নপুংসক করার পরেও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আমার স্বাভাবিক আকর্ষণের খবর ইনটেফের জানা নেই।
মেয়ের কর্মকাণ্ডে আমার মালিকের এই অমনোযোগিতা কোনো কোনো সময়, অবশ্যই লসট্রিসের চাপাচাপিতে, সাহসী কাজ করতে ইন্ধন জোগায় আমাকে; ঠিক যেমন হোরাসের প্রশ্বাসে করে শিকার অভিযানে অংশগ্রহণ। পার পেয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ বোধহয় আছে এবারেও।
সেই বিকেলে, নিজের বাসস্থানে কাজ শেষ করে আমার প্রিয় সঙ্গীদের খাবার দেওয়া এবং আদর করতে চললাম। পশুপাখির প্রতি বিশেষ অনুরক্ত আমি, এতটা বুঝি ওদেরকে, মাঝে-মধ্যে নিজেও অবাক হয়ে যাই। এক ডজন বিড়ালের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুও আছে আমার, কেউ ওদের মালিক হতে পারে না। অপরদিকে, একটা সুন্দর কুকুরের পালের মালিক আমি। মরুর বুকে বিশাল গ্যাজেল হরিণ আর সিংহ শিকারের সময় ওদের ব্যবহার করি আমি এবং ট্যানাস।
বুনো পাখিগুলো উড়ে এসে বসে চাতালে। আমার কাঁধ বা হাতে রাখা পিচ ফল খেতে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু করে। সবচেয়ে সাহসীগুলো আমার দুই ঠোঁটের মাঝখান থেকে কিরে খায়। পোষ মানানো গ্যাজেল হরিণগুলো আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে, ঠিক পোষা বেড়ালের মতোই। আর চাতালে নিজেদের অবস্থান থেকে আমার উদ্দেশ্যে কর্কশ কণ্ঠে ডাকতে থাকে বাজপাখি দুটো। মরুর শিকারী ওরা, বিশাল, হিংস্র, সুন্দর। সময় পেলে ওদের নিয়ে মরুভূমির গরমে ঘুরে আসি ট্যানাস এবং আমি। শিকারের পানে ওগুলোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর চোখ ধাঁধানো গতি দারুন আনন্দ দেয় আমাকে। আমি ছাড়া আর কেউ অবশ্য আদর করতে চাইলে লম্বা-হলুদ ঠোঁটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হতে হবে; আমার কাছে ওরা পোষা চড়ই।
আমার পোষ্যদের পরিচর্যার পালা শেষ হতে একজন দাস ছেলেকে ডেকে নিজের খাবার আনতে বললাম। নীল নদীর বিশাল সবুজ বিস্তারের অপূর্ব দৃশ্যের সামনে, চাতালে বসে মধু আর ছাগ-দুগ্ধ দিয়ে রান্না করা বুনো কোয়েলের মাংস খেলাম তৃপ্তির সাথে; প্রাসাদের প্রধান রাঁধুনি কেবল আমার জন্যেই তৈরি করেছে খাবারটা। ওখানে বসে নদীর ওপার থেকে আমার মালিকের ফিরে আসার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলাম। ছোট্ট, চৌকোণা পালে লেগে ঝকমক করছে মিশরীয় সূর্যাস্তের অপরূপ আলো; তার জলযানের প্রত্যাবর্তন আমার ভেতরে ভয়ের এক পশলা ঠাণ্ডা হাওয়া বইয়ে দিতে লাগল। হয়তো আজ সন্ধাতেই আমাকে ডেকে পাঠাবেন তিনি, কিন্তু এখনই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে প্রস্তুত নই আমি।