প্রায় এক হাজার বছর ধরে অভিনীত হয়ে আসা গীতি পুনলিখন করেছি আমি। বর্তমান দর্শকের কাছে আগের নাট্যের বচন বেশ আলঙ্কারিক এবং দুর্বোধ্য বলে মনে হবে। উৎসবের শেষ রাতে, ওসিরিসের মন্দিরে অভিনীত হবে গীতিনাট্যটি; মহান ফারাও থাকবেন প্রধান অতিথি হিসেবে। সে কারণেই বিশেষভাবে চিন্তিত আমি। প্রাজ্ঞ এবং পুরোহিতদের কাছ থেকে ইতিমধ্যেই নাট্যাংশ পুনর্লিখনের জন্যে আপত্তি উঠেছে। কেবল আমার মালিক, প্রভু ইনটেফের হস্তক্ষেপেই তাদের আপত্তি ধোপে টেকে নি।
আমার মালিক মোটেও ধার্মিক মানুষ নন, অন্য সময়ে হলে ধর্মীয় তত্ত্বকথায় বিতর্কে যেতেন না। তবে কিনা, কিছু বাক্যে তাঁকে স্তুতি করা হয়েছে। একটা ছুতো ধরে সেই বাক্যগুলো তাঁকে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলাম, এমনও বলেছিলাম, এটা প্রচারে প্রথম বাধা আসবে ওসিরিসের মন্দিরের বুড়ো পুরোহিতের কাছ থেকে। একবার, ছোটো বালকের অধিকার নিয়ে আমার মালিক ইনটেফের সাথে বিরোধ হয়েছিলো তার। আমার প্রভু, এই সমস্ত বাধা ক্ষমার চোখে দেখে অভ্যস্ত নন।
তো, আমার সংস্করণ প্রথমবারের মতো অভিনীত হতে যাচ্ছে। কুশীলবেরা যদি যথার্থভাবে আমার কাব্যের গৌরব ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, শেষবারের মতও প্রদর্শিত হবে নাটকটি।
ট্যানাস এবং লসট্রিস–ওদের দুজনের কণ্ঠস্বর যথেষ্ট শ্রুতিমধুর, ওদেরকে সাহায্য করার আমার প্রতিশ্রুতির পুরস্কার দিতে দুজনেই বদ্ধপরিকর। নিজেদের উজার করে দিলো ওরা, প্রতিটি শব্দে, বাক্যে আবেগের এমনই পরিস্ফুটন; নিজেকেই যেনো ভুলে গেলাম আমি।
হঠাৎই, গ্যালির সামনের কারো চিৎকারে দেবতাদের কল্পলোক থেকে বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে এলাম। নদীর শেষ বাঁক ঘুরছে আমাদের নৌবহর, সামনেই দেখা গেলো যমজ নগরী কারনাক এবং লুক্সর, দুটিতে মিলে তৈরি করেছে আমাদের মহান থিবেস নগরী। মুক্তোর কোনো নেকলেসের মতোই ঝলমল করছে তরুণ মিশরীয় সূর্যালোকে। নাটকের চমৎকার অবতরণিকা শেষ হয়ে গেছে, কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে এখন আমাদের। পায়ের উপর দাঁড়াতে আমার স্পৃহা যেনো টলমল করে উঠল।
ট্যানাস, আমি এবং লসট্রিসকে অবশ্যই ক্ৰাতাস-এর গ্যালিতে যেতে হবে; শহর কাছে চলে এসেছে। আমার মালিকের চরেরা সেই দূর থেকে নজর রাখছে। আমাদের একসঙ্গে দেখাটা ঠিক হবে না।
একটু দেরি হয়ে গেলো না? ট্যানাস হেসে বলে। আরো আগেই সেটা ভেবে রাখা উচিত ছিলো তোমার।
এমনিতেও আমার বাবা সবকিছু জানবেন, লসট্রিস এগিয়ে আসে প্রেমিকের কথার সমর্থনে। এতে করে বরঞ্চ তোমার কাজ আরো সহজ হয়ে গেলো।
যদি আমার চাইতে তোমার জ্ঞান বেশি হয়ে যায়, তবে যা ইচ্ছা করতে পারো; আমি আর এর মধ্যে নেই। কঠোর মুখাবয়ব ধারণ করলাম, সাথে সাথে কাজ হলো এতে।
ক্ৰাতাস-এর গ্যালিকে ইশারায় আমাদের পাশে নিয়ে এলো ট্যানাস, বিদায় জানাবার জন্যে অল্প কিছু সময় পেলো ওরা দুজন। অর্ধেক নৌবহরের সামনে আলিঙ্গনাদ্ধ হলো না বটে, কিন্তু ওদের পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিপাত আর কোমল স্বরের ফিসফিসানি জানিয়ে দিলো সবাইকে, যা জানার ছিলো।
ক্রাতাস-এর জাহাজের স্টার্ন টাওয়ারে দাঁড়িয়ে হোরাসের প্রশ্বাসকে বিদায় জানালাম আমরা, ঠিক চঞ্চল ফরিঙের মতো প্যাডল ঝাঁপটে লুক্সর নগরের সম্মুখের ঘাটের দিকে এগুল ওটা। নদীর উজানে, উজিরের প্রাসাদের উদ্দেশ্যে ভেসে চললো আমাদের জাহাজ।
*
প্রাসাদের ঘাটে নোঙর করতে না করতেই আমার মালিকের খোঁজ খবর করে একটু হলেও আশ্বস্ত হলাম। নদীর ওপারে নির্মাণাধীন ফারাওয়ের সমাধি এবং শেষকৃত্য-মন্দিরের কাজ তদারকি করতে গেছেন তিনি। গত বারো বছর ধরেই রাজার সমাধি এবং মন্দির নির্মাণ কাজ চলছে, ঠিক যেদিন থেকে দুই রাজ্যের সাদা এবং লাল রঙের মুকুট আরোহণ করেছেন আমাদের মহান ফারাও। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে কাজ, ওটা পরিদর্শনের জন্যে নিঃসন্দেহে উন্মুখ হয়ে আছেন ফারাও; ওসিরিসের উৎসব শেষ হতে না হতেই তা করবেন তিনি। আমার মালিক, ইনটেফ চাইছেন তাঁকে যে কোনো প্রকারে সন্তুষ্ট রাখতে। আমার মালিকের বহু পদবির মধ্যে একটি হলো, রাজকীয় সমাধির অভিভাবক; নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
তাঁর এই অনুপস্থিতি আরো একদিন সময় করে দিলো আমাকে, কিছু একটা ভেবে-চিন্তে বের করার জন্যে। কিন্তু, প্রেমিক যুগল আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছে, প্রথম সাক্ষাতেই তাদের কথা বলতে হবে।
হারেমে আমার মিসট্রেস নিরাপদে পৌঁছুতেই প্রাসাদের এক কোণে, উজিরের নিকটজনের জন্যে তৈরি করা নিজের প্রকোষ্ঠে ফিরে চললাম তরিঘরি করে।
তাঁর অন্যান্য কার্যাবলির মতোই আমার মালিকের পারিবারিক আয়োজনও বেশ চতুর। আটজন পত্নী আছে তার, প্রত্যেককেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক সুবিধা বা মোটা উপঢৌকনের বদৌলতে বিবাহ-শয্যায় নিয়েছেন তিনি। তবে তার মধ্যে তিনজনই কেবল সন্তান উপহার দিতে পেরেছে তাকে, আমার মিসট্রেস, লসট্রিস ছাড়াও দুই ছেলে আছে ইনটেফের।
যতদূর জানি, প্রাসাদের ভেতর-বাইরের সবকিছু আসলে আমার জানা, গত পনেরো বছরে একবারো হারেমে জান নি আমার মালিক। লসট্রিসের জন্ম ছিলো তার সর্বশেষ বৈবাহিক দায়িত্ব পালনের উদাহরণ। তার শয্যা-অভিরুচি ভিন্ন ধাতের। প্রাসাদে আমার অংশে বসবাস করে আমার মালিকের বিশেষ সঙ্গীরা; সমগ্র উচ্চ রাজ্যের সুদর্শন দাস-বালকের দল। বিগত একশ বছর ধরেই মহান মালিকদের তুষ্টিতে ওরা ভূমিকা পালন করে আসছে। আমাদের অসাধারণ সুন্দর জনপদের রুগ্ন ধারার এ ও একটি উদাহরণ বলা যায়।