লসট্রিস, শুরু করলাম আমি। এ আমার হতাশার বহিঃপ্রকাশ, সাধারণত ওর নাম ধরে সম্বোধন করি না। তুমি এখন আর শিশু নও। বাচ্চাদের মতো কল্পনায় নিজেকে ভাসিয়ে দিও না। তুমি জানো, তোমার বাবা কখনও সম্মত হবেন না
ও আমার কথা শুনবে না। সবচেয়ে সত্যি কথাটা শুনতে ও প্রস্তুত নয়, কথার তোড়ে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইল সে। আমি জানি, ট্যানাসের অত ধন সম্পদ নেই। কিন্তু ওর সামনে দারুন ভবিষ্যত পড়ে আছে। একদিন, সমগ্র মিশরের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেবে ও। তুমি দেখো, একদিন ওর নেতৃত্বে যুদ্ধে মিশরের দুই সাম্রাজ্য এক হবে, আমি সেদিন থাকব ওর পাশে।
মিসট্রেস, দয়া করে আমার কথা শোনো। ট্যানাসের ধন-সম্পত্তি নিয়ে কোনো কথা নেই। এরচেয়ে অনেক, অনেক বড় ব্যাপার।
তাহলে নিশ্চই ওর বংশধারা আর জন্ম নিয়ে কথা? ওটাই তো তোমার সমস্যা, না টাইটা? ভালো করেই জানো, আমাদের মতো ওরাও উচ্চ বংশীয়। পিয়াংকি, প্রভু হেরাব ছিলেন আমার বাবার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, তার সম মর্যাদার। ও আর আমার কোনো কথা শুনবে না। ও জানে না, কোনো ট্রাজেডির দ্বারপ্রান্তে এখন আমরা। ট্যানাস বা সে; ওরা কেউই জানে না। পুরো সাম্রাজ্যে সম্ভবত একমাত্র আমিই জানি সত্যিটা।
এতদিন ধরে ওর কাছ থেকে এই সত্যি গোপন রেখেছিলাম আমি, আর ট্যানাসকেও বলতে পারি নি কখনও। এখন কেমন করে ওকে বোঝাবো? কেমন করে ওকে বলব, তরুণ ট্যানাসের প্রতি তার বাবার গভীর ঘৃণার কথা? অপরাধবোধ আর ঈর্ষা থেকে জন্ম সেই ঘৃণা, হয়তো সে জন্যেই খুব বেশি স্থায়ী।
তবে, আমার প্রভু ইনটেফ খুবই চৌকস এবং চতুর মানুষ। চারপাশের লোকজনের কাছ থেকে সযত্নে আড়াল করে রেখেছেন তার অনুভূতি। তাঁর জিঘাংসা, ঘৃণাবোধ–সব লুকিয়ে রেখে হাসিমুখে চুমো খেয়েছেন তাঁরই হাতে ধ্বংস হওয়া কারো প্রতিনিধিকে। নদীর ধারে, পানির নিচে কাদায় লুকিয়ে থাকা কুমীরের মতো তাঁর ধৈৰ্য্য, সময় হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন অসতর্ক গ্যাজেলের উপর। প্রয়োজন হলে দিনের পর দিন, এমনকি দশক পার করে ফেলবেন; কিন্তু সুযোগ এলেই ছোবল মারবেন বিষাক্ত সরীসৃপের মতো তড়িৎ গতিতে।
বাপের এই বিষাক্ত স্পৃহা সম্বন্ধে একেবারে অজ্ঞ লসট্রিস। ও এমনকি বিশ্বাস করে তার বাবা পিয়াংকি, প্রভু হেরাবকে ভালবাসতেন। কিন্তু, ও জানবেই বা কেমন করে? এতদিন ধরে সত্যিটা তো আমিই গোপন রেখেছিলাম তার কাছে থেকে। নিষ্পাপ লসট্রিসের ধারণা, কেবল বংশ পরিচয় আর ধন-সম্পদ-ই ট্যানাস আর ওর মিলনের পথে একমাত্র বাধা।
তুমি জানো, এটা সত্যি, টাইটা। আভিজাত্যের তালিকায় ট্যানাস আমাদের সমান। মন্দিরের বেদীতে সবকিছু লেখা আছে। কেমন করে আমার বাবা না মেনে থাকবেন? তুমিই বা কেমন করে অমান্য করবে?
এটা মানা বা না মানার ব্যাপার নয়, মিসট্রেস–
তাহলে তুমি আমার বাবার কাছে যাচ্ছ, আমাদের ব্যাপারে কথা বলতে, তাই না টাইটা? বল, যাবে তুমি; যাবে না?
দৃষ্টির হতাশা আড়াল করে মাথা ঝাঁকালাম আমি।
*
কারনাকের উদ্দেশ্যে ফিরতি যাত্রায় চললো আমাদের জাহাজ বহর। কাঁচা চামড়া আর লবল দেওয়া মাংসের ভারে প্রতিটি গ্যালির পাটাতন পানি ছুঁই ছুঁই করছে। নীল নদের বিপরীতমুখী শক্তিশালী স্রোতের কারণে যাওয়ার সময় যেমনটা হয়েছিলো, তার তুলনায় ধীরে চলছে; তবে আশঙ্কায় জর্জরিত আমার হৃদয়ে দ্রুতই
মনে হতে লাগলো সেটা। সদ্য-ঘোষিত তরুণ প্রেমের উন্মাদনায়, পরস্পরের মিলনের পথে সব বাধা হটিয়ে দেওয়ার প্রত্যয়ে যেনো ভেসে যাবে প্রেমিক-যুগল। এই সুখ-স্বপ্নে বাগড়া দিতে মন সায় দিলো না, কারণ আমি নিঃসন্দেহে জানি, অন্তরঙ্গভাবে পরস্পরকে পাওয়ার দিন ওদের শেষ হতে চললো বলে। যদি সঠিক শব্দ বা সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারতাম, আমার মনে হয়, ওদের সত্যিকার মিলনে উৎসাহিত করতাম আমি; যা নিয়ে এতো ভয় পেয়ে গেছিলাম কাল রাতে। আর কখনও এমন সুযোগ পাবে না ওরা, যদি ইনটেফকে মূল ঘটনা জানাই। একবার ব্যাপারটা জানাজানি হলেই চিরদিনের মতো ওদেরকে আলাদা করে ফেলার বন্দোবস্ত করে ফেলবেন তিনি।
তাই, যতোটা পারি, ওদের মতোই হাসলাম আর আনন্দে মেতে থাকলাম; নিজের আশঙ্কা লুকিয়ে রাখলাম বহু চেষ্টায়। ভালোবাসায় এতটাই অন্ধ হয়ে আছে ওরা, কোনো সমস্যাই হলো না তা করতে; অন্য কোনো সময় হলে আমার মিসট্রেস খুব সহজেই ধরে ফেলতো আমার অনুভূতি। ওকে যতোটা জানি আমি, আমাকে ঠিক ততটাই ভালোভাবে চেনে সে।
গলুইয়ে বসে আমরা তিনজনে উৎসবের আকর্ষণ, ওসিরিসের গীতিনাট্য নিয়ে আলোচনা করছিলাম। নাটকের সঞ্চালক হিসেবে আমাকে মনোনীত করেছেন আমার মালিক প্রভু ইনটেফ, প্রধান চরিত্রের জন্যে ট্যানাস এবং লসট্রিস দুজনকেই নিয়েছি আমি।
প্রতি দুই বছরে একবার করে হয় এই উৎসব, ওসিরিসের পূর্ণিমায়। একটা সময়ে বছরে একবার করে হোত। কিন্তু, খরচ এবং প্রশাসনিক ঝামলোর কারণে মহান ফারাও, দুই উৎসবের মধ্যবর্তী ব্যবধান বাড়ানোর সমন জারি করেছেন। প্রতি উৎসবে সেই গজ-দ্বীপ থেকে থিবেস-নগরীতে স্থানান্তর করতে হয় রাজকার্য ।
গীতিনাট্যের চিন্তা সাম্প্রতিক আশঙ্কা থেকে খানিকটা হলেও রেহাই দিলোলা আমাকে। প্রেমিক যুগলকে তাদের নিজস্ব অংশ মুখস্ত করাতে লাগলাম। ওসিরিসের স্ত্রী, আইসিস-এর চরিত্র অভিনয় করবে লসট্রিস; আর প্রধান চরিত্র, হোরাসের ভূমিকায় ট্যানাস। লসট্রিসের ছেলের ভূমিকায় ট্যানাসের অভিনয়ের সম্ভবনায় ওরা দুজন হেসে খুন হয়, আমি বোঝালাম, দেব-দেবীদের বয়স বলে কিছু নেই, নিজের সন্তানের চেয়ে তাই তাদের বয়স কম দেখানোটা অস্বাভাবিক নয় বৈকি!