উঠে দাঁড়িয়ে ট্যানাসের দিকে যাচ্ছিল সে, আমাকে দেখে ফেলল দরোজায়। ছায়ায় মিশে যেতে ইচ্ছা হলো আমার, এতো আবেগঘন মুহূর্তে ওদের চুপিসারে দেখছি বলে লজ্জিত। কিন্তু, আমি পালিয়ে যাওয়ার আগেই আনন্দে ঝলমল করে উঠলো লসট্রিসের চোখ-মুখ, দৌড়ে এসে আমার হাত আঁকড়ে ধরলো ও।
ওহ, টাইটা! তুমি এখানে, কী যে খুশি লাগছে আমার! সত্যি, তোমারই অভাব ছিলো! হাত ধরে টেনে স্যাঙ্কটাম-এর দিকে নিয়ে যায় সে আমাকে। উঠে দাঁড়িয়ে আমার উদ্দেশ্যে স্মিত হাসলো ট্যানাস, অপর হাতটা ধরলো।
এখানে আসার জন্যে ধন্যবাদ । জানি, তোমার উপর সবসময় ভরসা করা যায়। যদি সত্যিই আমার উদ্দেশ্য এতটা খাঁটি হোত, যা ওরা ভাবছে। নিজের অপরাধদগ্ধ হৃদয় আড়াল করতে স্নেহের হাসি হাসলাম।
নিচু হও! লসট্রিস আদেশ করে আমাকে। শোনো, আমরা যা কিছু বলব, সব শোনো। দেবী হাপি আর মিশরের সব দেবতাদের সামনে তুমি আজ সাক্ষী হয়ে থাকবে। আমাকে হাঁটু ভাঁজ করে দাঁড়াতে চাপ দেয় সে, পরস্পরের হাত ধরে দেবীর মূর্তির সামনে চোখে চোখে তাকায় ওরা।
লসট্রিস বলে উঠে প্রথমে। তুমি আমার সূৰ্য্য, ফিসফিস করে বলে ও। তুমি ছাড়া আমার দিনগুলো অন্ধকার।
তুমি আমার হৃদয়ের নীল নদ, শান্ত স্বরে প্রত্যুত্তর করলো ট্যানাস। তোমার ভালোবাসার জল আমাকে পবিত্র করে।
এই জীবনে, আর যত জীবন আছে সবসময় তুমিই আমার মনের মানুষ।
তুমি আমার নারী, তোমাকে প্রার্থনা করছি, প্রিয়। হোরাসের রক্ত আর প্রশ্বাসের নামে কসম। পরিষ্কার, মুক্ত কন্ঠে বলে ট্যানাস, পাথুরে দেওয়ালে প্রতিধ্বনি তোলে তার আওয়াজ।
তোমার আবেদন মঞ্জুর করলাম, এর বিপরীতে সহস্রগুন ফেরত দেব, বলে চলে লসট্রিস, আমাদের মধ্যে কখনও কেউ আসতে পারবে না, কোনো কিছুই পারবে না আমাদের বিচ্ছেদ করতে। চিরজীবনের জন্যে আমরা এক হলাম।
মুখ উঁচিয়ে দয়িতের উদ্দেশ্যে মেলে ধরে লসট্রিস। ধীরে, গভীরভাবে চুমো খায় ওরা। আমার জানা মতে, এ হলো প্রেমিক যুগলের প্রথম চুম্বন। এতে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত অবলোকন করতে পেরে সম্মানিত বোধ করলাম।
ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন আলিঙ্গনাবদ্ধ হলো ওরা, ল্যাগুন থেকে ভেসে আসা এক পশলা ঠাণ্ডা বাতাস মন্দিরের স্বল্পালোকিত ঘরটাকে এলোমেলো করে ফেলল; মশালের শিখা কেঁপে উঠে নিভু নিভু হলো, এক মুহূর্তের জন্যে আমার চোখের আড়াল হয়ে গেলো প্রেমিক যুগল, আর দেবীর অবয়ব যেনো কেঁপে উঠে কিছু একটা বলতে চাইলো। যেমন করে এসেছিল, হঠাৎই চলে গেলো হাওয়া, কিন্তু বিশাল পাথুরে স্তম্ভের আড়ালে তার কানাকানি চললো অনেকক্ষণ; মনে হলো, যেনো দূরাগত প্রচণ্ড হাসিতে ভেঙে পড়ছেন দেব-দেবীরা। অতিন্দ্রিক আবেগে কেঁপে উঠলাম আমি।
দেবতাদের কাছে অতি-দাবি সবসময়ই বিপদজনক, আর এইমাত্র অসম্ভবের কামনা করেছে লসট্রিস। বহুদিন থেকেই এই দিনটির ভয় করে আসছিলাম আমি, নিজের মৃত্যু দিনের চেয়েও এ আমার কাছে অনেকগুন আতঙ্কের। যে প্রতিজ্ঞা এইমাত্র পরস্পরের প্রতি করেছে ট্যানাস আর লসট্রিস, তা কখনই টিকে থাকবে না। যত গভীর ভাবেই ওরা বলুক না কেন, এ হওয়ার নয়। শেষমেষ, ওরা যখন ঠোঁট সরিয়ে নিয়ে আমার দিকে ফিরল, মনে হলো, বুকটা যেনো ভেঙে যাবে আমার।
তুমি এতো দুঃখিত কেন, টাইটা? আনন্দে ঝলমল মুখে জানতে চায় লসট্রিস। আমার সাথে হাস না। আজ যে আমার জীবনের সেরা দিন।
জোর করে একটু হাসলাম আমি, কিন্তু কোনো কথা জোগাল না মুখে। হৃদয়ে তোলপার, ঠোঁটে হাসি নিয়ে এই পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ দুজনের দিকে তাকালাম ।
উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে আলিঙ্গন করলো ট্যানাস। আমার পক্ষ থেকে প্রভু ইনটেফের সঙ্গে কথা বলবে তুমি, তাই না? দাবি জানায় সে।
হ্যাঁ, টাইটা, লসট্রিস যোগ দেয় এই আবেদনে। বাবা তোমার কথা শুনবেন। এক তুমিই আছো, আমাদের জন্যে পারবে এটা করতে। করবে না, টাইটা? জীবনে কখনও আমাকে না কর নি তুমি, আমার জন্যে করবে না এটা?
কি বলব আমি ওদের? নিঠুর সত্যি কথাটা কেমন করে বলব? এই সজিব ভালোবাসাকে কী বলে মানাবো? ওরা অপেক্ষা করছে আমার উত্তরের জন্যে, চাইছে। আমি আনন্দ প্রকাশ করি, প্রতিজ্ঞা করি, সাহায্য করবো ওদের। কিন্তু বোবার মতো বসে রইলাম, শুষ্ক মুখে কথা সরছে না।
টাইটা, কী হলো? আমার মিসট্রেসের প্রিয় কমনীয় মুখে যেনো সন্ধার আঁধার ঘনালো। আমাদের সাথে আনন্দ করছ না কেন?
তোমরা জানো, তোমাদের দুজনকেই ভালোবাসি আমি, কিন্তু কথা শেষ করতে পারছি না আমি।
কিন্তু? কিন্তু কি, টাইটা? উদ্বিগ্ন লসট্রিস জানতে চাইল, আমার জীবনের সবচেয়ে সুখী দিনে অমন করছ কেন তুমি? রেগে যাচ্ছে ও, বুঝলাম; একইসঙ্গে বিন্দু বিন্দু অশ্রু জমা হচ্ছে চোখের কোণে। আমাদের সাহায্য করবে না তুমি? এতো বছর ধরে এতো অসংখ্যবার তাহলে এমনি প্রতিজ্ঞা করেছিলে আমার কাছে? আমার সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল ও, দৃষ্টিতে রোখ ।
মিসট্রেস, ওভাবে কথা বলো না। এমন ব্যবহার আমার পাওনা নয়। শোনো, আমার কথা! ওর ঠোঁটে আঙুল রেখে আরো একটা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আঁকলাম । আমি নই, তোমার বাবা, আমার মালিক প্রভু ইনটেফ–
ঠিক তাই। অধৈৰ্য্য লসট্রিস হাতের এক ঝাঁপটায় আমার হাতে সরিয়ে দেয় ওর মুখের উপর থেকে। আমার বাবা! তুমি তার কাছে গিয়ে আমাদের ব্যাপারে কথা বলবে, সবসময় যেমন করে বল। সবকিছু তাহলে ঠিক হয়ে যাবে।