মন্দিরে নিয়ে চল, ক্ৰাতাস! তাড়াতাড়ি! কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম। দেবী হাপি, আমাদের যেনো খুব বেশি দেরি হয়ে না যায়?
সন্ধার বাতাসে তেকোণা পাল পতপত করে উড়ে, মুহূর্ত পরেই কালো পানি পেরিয়ে মন্দিরের পাথরের ঘাটে ভীড়লো নৌকা। খুঁটির সাথে জলযানটা বেঁধে আমাকে পথ দেখাতে উদ্যত হয় কাতাস; আমি থামালাম ওকে।
আমার নয়, ট্যানাসের খাতিরে, বললাম আমি, দয়া করে অনুসরণ কোর না।
এক মুহূর্তের জন্যে অস্বস্তিতে ভুগলো ক্ৰাতাস, শেষমেষ মাথা নেড়ে সায় দেয় । প্রয়োজন হলে ডাক দিয়ো। নিজের তরবারিটা খুলে হাতল এগিয়ে দিলো আমার দিকে। এটা প্রয়োজন হতে পারে।
মাথা নাড়লাম আমি। সে ধরনের কোনো বিপদ নয়। আর তাছাড়া, ছুরি আছে সঙ্গে। আমাকে বিশ্বাস করার জন্যে ধন্যবাদ। ওকে সেখানে ফেলে রেখে মন্দিরের গ্রানাইটের সিঁড়ি বেয়ে প্রবেশপথের দিকে ছুটলাম।
উঁচু প্রবেশ মুখের বাঁকানো পথে জ্বলন্ত মশালগুলো এক অপার্থিব আলো ছড়াচ্ছে, যেনো দেওয়ালে খোদাই করা মূর্তিগুলো এখনই হেসে উঠবে। দেবী হাপির প্রতি আমি বিশেষ অনুরক্ত। মূলত, তিনি না দেবতা, না দেবী অদ্ভুত অবয়ব তার; দাঁড়ি-মুখো, উভলিঙ্গিক, বিশাল পুংজননেন্দ্রীয় এবং নারী যোনী উভয়ই আছে। আর রয়েছে বিপুল আয়তন বক্ষযুগল আমাদের সকলকে দুধ বিলোয় সেটা। তিনি হলেন নীল নদের প্রতিরূপ, চাষ-কার্যের দেবী। মিশরের দুই রাজ্যের সকল অধিবাসী বিশাল এই নদীর পর্যাক্রম বন্যার জন্যে তারই অনুকম্পার উপর নির্ভর করে। যখন ইচ্ছে তখন নিজের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে সক্ষম উনি, আমাদের এই মিশরের অন্যান্য বহু দেব-দেবীর মতো পারেন যে কোনো প্রাণীর আকার ধারণ করতে। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় অবয়ব হলো জলহস্তির। এহেন ঘোলাটে লিঙ্গ পরিচয় হওয়া সত্ত্বেও আমার কর্ত্রী, লসট্রিস সবসময় তাকে নারী বলেই মনে করে; আমি নিজেও তাই করি। হাপির মন্দিরের পুরোহিতেরা অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন।
পাথরের দেওয়ালে তাঁর ছবিগুলো বিশাল, মাতৃ-তুল্য। লাল, নীল এবং হলুদের মৌলিক রঙে আঁকা, জলহস্তি সদৃশ মুখ নিয়ে নিচে দৃষ্টিপাত করে আছেন, প্রকৃতির সবকিছুকে যেনো সঙ্গমে আহ্বান করছেন। আমার বর্তমান উদ্বেগের সাথে অবশ্য এই আহ্বান ঠিক যায় না! ভয় হতে লাগল, হয়তো আমার অপরিণত মিসট্রেস এখন দেবীর নির্লজ্জ আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেহজ সুখে মত্ত।
পার্শ্ব-বেদীতে বসে ঝিমোচ্ছিল একজন নারী পুরোহিত, দৌড়ে তার কাছে চলে এলাম আমি, মাথার টুপির কিনারা ধরে ঝাঁকালাম অধৈৰ্য্য ভঙিতে । পবিত্র ভগিনী, আমাকে বলুন, রাজ-উজিরের কন্যা লসট্রিসকে দেখেছেন? উচ্চ-মিশরের খুব কম লোকই আছেন, যারা দেখামাত্র আমার মিসট্রেসকে চিনবে না। তার সৌন্দর্য্য, শিশুতোষ আগ্রহ আর চমৎকার মিষ্টি ব্যবহারের জন্যে দোকান, রাস্তা যেখানেই যাক, সবাই ঘিরে রাখে লসট্রিসকে।
ফোকলা দাঁতে আমার উদ্দেশ্যে হাসলো বুড়ি। এক হাত দিয়ে নাকের পাশে এমন ধরনের একটা ভঙ্গি করে দেখাল, আমার চরম আশঙ্কা সত্যি বলে মনে হলো।
এবারে কর্কশভাবে আঁকালাম বুড়িকে। কোথায় সে, বুড়ি মা? বলুন আমাকে! কিন্তু চোখদুটো কোটরের ভেতর ঘুরিয়ে হাসলো সে।
গ্রানাইটের চাতাল ধরে দৌড়ালাম আমি, পায়ের চেয়ে যেনো দ্রুত চলছে হৃদপিণ্ড; কিন্তু এতো কিছুর মাঝেও আমার মিসট্রেসের সাহস নিয়ে ভাবছিলাম। যদিও উচ্চ বংশীয় হওয়ার কারণে যে কোনো পবিত্র স্থাপনায় তার প্রবেশাধিকার আছে, কিন্তু পুরো মিশরেও ভালোবাসার এমন একটি স্থান নির্বাচনের সাহস কার আছে?
মঠ-এর প্রবেশ মুখে থমকে দাঁড়ালাম। আমার অতিন্দ্রীয় সত্যি কথাই বলেছে। ওই তো ওরা দুজন, ঠিক যেমনটা আশঙ্কা করেছিলাম। প্রায় চিৎকার করে উঠেছিলাম, জোর করে শান্ত করলাম নিজেকে।
স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আড্র আমার মিসট্রেস; ওর বুক জোড়া ঢাকা, মাথার উপর নীল উলের একটা শাল ফেলে রেখেছে। দেবী হাপির বিশাল মূর্তির সামনে উঁবু হয়ে রয়েছে সে।
পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ট্যানাস। নিজের অস্ত্র এবং ঢাল একপাশে সরিয়ে রেখেছে। মঠের সামনে ওগুলোকে দেখে এসেছি আমি। লিনেন কাপড় আর খাটো টিউনিক পরনে, পায়ে স্যান্ডল। হাতে হাত ধরে আছে প্রেমিক যুগল, ফিসফিস করে কথা বলছে, প্রায় জোড়া লেগে আছে দুটো মাথা।
আমার প্রকৃত সন্দেহ তিরোহিত হলো, লজ্জা আর অপরাধবোধ ঘিরে ধরছে এখন। কেমন করে আমার মিসট্রেসকে সন্দেহ করতে পারলাম? ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগলাম। পার্শ্ব-বেদীর সামনে এসে ধন্যবাদ জানালাম দেবীকে, নীরবে দেখছি ওদের দুজনকে।
সেই মুহূর্তে, উঠে দাঁড়িয়ে দেবীর মূর্তির উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো লসট্রিস। ওর তরুণী দেহের সৌন্দর্য্যে এতটাই বিমোহিত হলাম, নড়তে পারছি না আমি।
গলার চারধারে ঝোলানো ল্যাপিস-লাজুলির ছবি আঁকা আমার দেওয়া উপহারটা খুলে নিল ও। বেদনার সাথে বুঝলাম, সে হয়তো দান করতে যাচ্ছে ওটা। ওর প্রতি আমার সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে নেকলেসটা তৈরি করেছিলাম, অন্য কোথাও ওটাকে আমি সহ্য করতে পারব না। পায়ের পাতার উপর দাঁড়িয়ে মূর্তির গলায় ওটা পরিয়ে দেয় লসট্রিস। এরপরে নিচু হয়ে চুমো খায় পাথুরে পদতলে। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল ট্যানাস।