নারী সত্তা লাভের মতো আবেগী দিনে, আজ, এই উন্মত্ত চরাচরে, আঁধার রাতে, সুপুরুষ এবং একই রকম তেজ-দীপ্ত কোনো সৈনিকের বাহুলগ্না হয়ে সে কী সীমা লঙ্ঘন করতে পারে না? আর তাছাড়া, ওকে তো সে ভালোবাসে।
যতোটা না আমার মিসট্রেসের কুমারীত্বের জন্যে, তার চেয়ে নিজের ভাগ্য নিয়ে শঙ্কিত হলাম আমি। সকালে কারনাকে, আমার মালিক ইনটেফের প্রাসাদে যখন যাব, তার কানে ঠিকই পৌঁছুবে আমার দায়িত্ব পালনে অযোগ্যতার কথা।
আমার মালিকের গুপ্তচরের অবাধ বিচরণ সমাজের প্রতিটি স্তরে, আমাদের ভূমির প্রতিটি কোণে; এমনকি, খোদ ফারাওয়ের প্রাসাদে পর্যন্ত। আমার চেয়ে অনেক লম্বা তাঁর হাত, অবশ্য দেওয়ার মতো এতো অর্থও নেই আমার। তবে তার এবং আমার গুপ্তচরেরা ক্ষেত্রবিশেষে একই লোক। লসট্রিস যদি আমাদের সবাইকে অপমান করেই ফেলে, সকালের আগেই সেটা জেনে যাবেন আমার মালিক; জানব আমিও।
জাহাজের একমাথা থেকে অপর মাথায় দৌড়ে চললাম আমি, খুঁজছি ওকে। স্টার্ন টাওয়ারে চড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরলাম বেলাভূমি। ট্যানাস বা লসট্রিস কারও চিহ্ন মাত্র নেই। আমার আশঙ্কা আরো দৃঢ় হয়।
এই উন্মাদ-রাতে কোথায় খুঁজব আমি ওদের? হতাশার প্রাবল্যে হাত ঝাঁপটাচ্ছি, নিজেকে স্থির করার প্রয়াস পেলাম। সবসময়ই নিজের অবয়বে নারীর প্রকাশভঙ্গি ঝেড়ে ফেলতে সচেষ্ট আমি। নপুংসক নয়, বরঞ্চ একজন পুরুষ মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিবেশনের চেষ্টা করি।
প্রাণান্ত চেষ্টায় নিজেকে শান্ত করলাম, শান্ত-যুক্তিতে বিচার করতে চাইলাম পরিস্থিতি; যুদ্ধের প্রচণ্ডতায় ট্যানাসকে এমন করতে দেখেছি বহুবার। মাথা ঠাণ্ডা হতে যুক্তি ফিরে এলো আমার মধ্যে। কী রকম ব্যবহার করতে পারে আমার মিসট্রেস, ভাবতে বসলাম। ওকে আমি অন্তরঙ্গভাবে জানি। চৌদ্দটি বছর ধরে তো ওকে দেখেই আসছি। মনে হলো, লসট্রিসের মধ্যে অনুশাসন আর নিজের উঁচু বংশপরিচয়ের বোধ এতো প্রবল; উন্মত্ত রাতে, বেলাভূমির অবর্ণনীয় লালসায় ও নিজেকে ভাসিয়ে দেবে না; ঝোঁপের আড়ালে মিলিত হবে না কামার্ত কুকুরীর মতো। একটা ব্যাপার নিশ্চিত, ওদের দুজনকে খুঁজে বের করতে কারো সাহায্য নেওয়া যাবে না। তার অর্থ হবে আমার মালিক ইনটেফের কানে কথাটা পৌঁছে দেয়া। নিজেকেই করতে হবে, যা কিছু করার আছে।
কোন গোপন স্থানে নিজেকে নিয়ে যেতে দেবে লসট্রিস? এই বয়সের যে কোনো– তরুণীর মতোই আবেগী ভালোবাসার ধারণায় পরিপূর্ণ ওর মন। ওই দুটো বজ্জাত কালো দাসী মেয়েও ভালোবাসার শারীরিক ব্যাপার সম্পর্কে তাকে প্রলুব্ধ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। আমি নিজেও অবশ্য একবার চেষ্টা করেছিলাম এ সম্পর্কিত কিছুটা জ্ঞান দিতে, ওটা আমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে, যাতে করে নিজেকে ভবিষ্যতে রক্ষা করতে পারে সে; কিন্তু তেমন আগ্রহ দেখায় নি লসট্রিস।
বুঝতে পারছি, এমন কোথাও খুঁজতে হবে ওকে, যার সাথে তার আবেগী মনের মিল আছে। হোরাসের প্রশ্বাসে কোনো ব্যক্তিগত কক্ষ থাকলে, সেখানেই আগে ছুটে যেতাম। কিন্তু আমাদের যুদ্ধ গ্যালিগুলো ছোটো, গতি এবং নিয়ন্ত্রণের জন্যে বিলাসিতা বর্জন করা হয়েছে ওগুলো থেকে। খোলা পাটাতনে ঘুমায় নাবিকেরা, এমনকি জাহাজের অধিনায়ক পর্যন্ত কিছুটা আড়াল করা একটা স্থানে রাত কাটায়। এখন, এমনকি কোনো আড়ালও নেই ডেকে, গোপনে মিলিত হওয়ার কোনো উপায় অন্তত হোরাসের প্রশ্বাসে নেই।
কারনাকে, আমাদের প্রাসাদ এখনও অর্ধেক দিনের পথ। উৎসবরত জনতার থেকে একটু তফাতে, ছোটো একটা দ্বীপ-মতো জায়গায় মাত্র তাঁবু খাড়া করা হচ্ছে আমাদের জন্যে। দাসগুলো নিশ্চই উৎসবে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়েছিল, না হলে এতো দেরি হওয়ার কথা নয় তবু তৈরিতে। মশালের আলোতে দেখতে পেলাম বেশ টলছে ওদের কেউ কেউ, দড়ি-দড়া হাতে। লসট্রিসের বিলাসবহুল, ব্যক্তিগত তবু এখনও তৈরি করা হয় নি যে, কার্পেট, দামী পর্দা আর লিনেন চাদরের সুখ হাতছানি দিয়ে ডাকবে প্রেমিক যুগলকে। তাহলে কোথায় যেতে পারে তারা?
ঠিক সেই মুহূর্তে নরম, হলুদ একটা আলো আমার মনোযোগ কেড়ে নিল । ল্যাগুনের ওপাশ থেকে আসছে আলোটা। সাথে সাথেই আমার অতিন্দ্রীয় সাড়া দেয়। আমার মিসট্রেসের সাথে দেবী হাপির যোগাযোগের কথা মনে হতে বুঝতে পারলাম, ল্যাগুনের ঠিক মধ্যিখানে দ্বীপের উপর তৈরি ছবির মতো সুন্দর তার মন্দির হাতছানি দিয়ে ডেকেছে তাকে। ওখানে যাওয়ার কোন উপায়ের খোঁজে তীরে চোখ বোলালাম আমি। মন্দিরে যাওয়া-আসার জন্যে ছোটো নৌকা আছে বটে, তবে মাঝিরা সবাই মাতাল, পড়ে আছে বেহুশ হয়ে।
ক্ৰাতাসকে দেখতে পেলাম তীরে। শিরস্ত্রাণের অস্ট্রিচের পালক সাধারণ জনতার মাথার উপরে গর্বিত ভঙ্গিতে উঁচু হয়ে আছে।
ক্ৰাতাস! চিৎকার করে ডাকতেই আমার দিকে ফিরে হাত নাড়ে সে। ক্ৰাতাস হলো ট্যানাসের ডান হাত; আর সম্ভবত আমি বাদে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন। অন্ধের মতো ওকে বিশ্বাস করতে পারি আমি।
একটা নৌকা জোগাড় কর! ওর উদ্দেশ্যে চেঁচালাম। যে কোনো একটা! আমার স্বরের তাগিদ ঠিকই পৌঁছুল কাতাসের কানে। অহেতুক প্রশ্ন করা বা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগার মানুষ নয় সে। তীরের সবচেয়ে কাছাকাছি ফেলুচার দিকে এগুল। মরার মতো ঘুমোচ্ছিল মাঝি। ঘাড়ের কাছের জামা ধরে শূন্যে তুলে তাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল ক্ৰাতাস। ঠিক যেমন করে পড়লো, সেইভাবেই ঘুমিয়ে রইল বেচারা; সস্তা চোলাই মদের নেশায় বুদ। নিজেই নৌকাটা চালিয়ে হোরাসের প্রশ্বাসের পাশে এনে ভেড়াল ক্ৰাতাস। টাওয়ারের মাথা থেকে লাফিয়ে ছোটো নৌকাটার উপরে পড়লাম আমি।