দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ মেপে দেখতে লাগলাম আমি; কসাইরা তাদের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। জলহস্তি শিকারে যে সামান্য মায়াও জেগেছিল মনে, এই নির্মম প্রাণিগুলোর জন্যে আমার কাছে তার ছিটেফোঁটাও নেই। বিষাক্ত সাপ ছাড়া এরচেয়ে নিঠুরতম প্রাণি আমার কাছে আর কোনোটিই নয়।
আমার ঘৃণা আরো বাড়ল যখন দেখতে পেলাম, এক কসাইয়ের ছুরির পোঁচে পেট কেটে যেতেই বিশাল সরীসৃপের ভেতর থেকে বেরুল অর্ধ-পাচিত একজন হতভাগ্য মেয়ের দেহাবশেষ। শরীরের পুরো উপরিভাগ আস্ত গিলে খেয়েছিল জানোয়ারটা; কোমরের উপর থেকে। গলার চারধারে একটা নেকলেস রয়েছে হতভাগিনীর, হাড় জিরজিরে হাতে পরে আছে লাল-নীল সিরামিকের অদ্ভুত সুন্দর বাজুবন্ধ।
এই খবর রটে যেতেই দুঃখ আর আতঙ্কের মর্মান্তিক চিল্কারে ভারী হয়ে আসে বাতাস। ভীড়ের মধ্য থেকে ঠেলে-ধাক্কিয়ে সৈন্যদের সরিয়ে বিভৎস দেহটার পাশে আছড়ে পড়ল একটা মেয়েমানুষ। শোকের মাতমে স্থির হয়ে থাকে চরাচর।
আমার মাণিক! আমার মেয়ে! গত দিনই প্রাসাদে এসে ওর মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার খবর জানিয়েছিল মহিলা। প্রাসাদের রক্ষীরা তাকে বলেছিল, হয়তো অপহরণের পরে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে তাকে দস্যুর দল। শহরের দ্বারে দিনে-দুপুরে এখন চলে এই দস্যুদের রাজত্ব; বিরাট একটা শক্তি হয়ে মাথাচাড়া দিয়েছে এরা। প্রাসাদের রক্ষীরা মহিলাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, ওর মেয়েকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। দেশের আইন-কানুনের উর্ধে চলে গেছে এই দস্যুদের কর্মকাণ্ড।
অন্তত একবারের জন্যে হলেও সেই অনুমান ভুল প্রমাণিত হলো। হতভাগ্য লাশের থেকে স্বর্ণালঙ্কারগুলো নিয়ে নেয় মহিলা। খুব খারাপ লাগছে আমার, শূন্য একটা সুরার পাত্র আনতে পাঠালাম আমি। দেহাবশেষগুলো সুরার পিপে হতে স্থানান্ত রের সময় চোখের পানি আটকে রাখা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে।
বুকের কাছে হতভাগিনী মেয়ের দেহাবশেষ সমেত পাত্রটা আঁকড়ে ধরে হেঁটে চলে মা টা; একটা ব্যাপার ভেবে দুঃখবোধ প্রবল হলো আমার। যত প্রার্থনা করা হোক না কেন, যত আচার পালন করা হোক; এমনকি, এই হত-দরিদ্র মহিলা যদি তার সন্তানের যেন-তেন একটা মমি পর্যন্ত প্রস্তুত করেও ফেলে, মৃত্যুর পরের জীবনে কখনও মুক্তি পাবে না মেয়েটার আত্মা। সেরকম হতে হলে, শব প্রস্তুতির আগে অক্ষত থাকতে হয় মৃতদেহ। নিরুপায় মায়ের জন্যে কেঁদে উঠে আমার মন। এ আমার এক ধরনের দুর্বলতা; জগতের সকল অন্যায্য আর দুঃখ বড় বেশি বুকে বাজে। বরং শক্ত হৃদয় হওয়াটা জরুরি।
সবসময়ের মতোই, দুঃখবোধ ভুলে থাকতে আমার তুলি আর প্যাপিরাস স্ক্রোল তুলে নিলাম। আমার চারপাশে চলতে থাকা ঘটনাবলি লিখে নিতে লাগলাম; সবকিছু সেই হারপুন শিকারী, হতভাগ্য মা, চামড়া সংগ্রহ, জলহস্তি বধ, কুমীর নিধন আর আমার লোকজনের পৈশাচিক ভোজ সবকথা দৃশ্যমান হতে থাকল আমার তুলির আঁচড়ে।
ইতিমধ্যেই মদ আর মাংসে আকণ্ঠ পরিপূর্ণ জনতার যে যেখানে ঢলে পড়েছে, সেখানেই ঘুমাচ্ছে নাক ডেকে। এখনও যারা দাঁড়িয়ে আছে দু পায়ের উপর, তাদের কেউই লাথি-গুতো আমলে নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। তরুণ, নির্লজ্জ ছেলেমেয়েরা আলিঙ্গন আর আদরে ভরিয়ে তুলছে পরস্পরকে; ঘনায়মান অন্ধকার আর হালকা ঝোঁপের ছায়ায়, প্যাপিরাসের বিছানায় মত্ত হয়েছে আদিম কামনায়। এদের অশ্লীল আচরণ পুরো জাতির ঝিমিয়ে পড়া অবস্থানের রূপক বলা যায়। এর কিছুই হতো না, যদি আমাদের একজন ইস্পাত-দৃঢ় ফারাও থাকতেন। শক্ত চরিত্রের, মনোবল আর অনুশাসনের বান্ধব কেউ যদি হতেন সিংহভাগ থিবেস নগরীর প্রভু। সাধারণ জনতা ঊর্ধস্তনদের থেকেই তো শিক্ষা নেয়।
যা ঘটেছে, যদিও আমি এর কিছুই অনুমোদন করি না, তথাপি প্রতিটি ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ করে যেতে লাগলাম। লেখা আর আঁকার ফাঁকে কেমন করে যেনো পেরিয়ে গেলো একটি ঘণ্টা; টের পাই নি। হোরাসের প্রশ্বাসের চালকের প্রকোষ্ঠে বসে লিখছিলাম এতটা সময়। পশ্চিমে ঢলে পড়েছে সূর্য, যেনো বিশাল নদী গহ্বরে ডুবে যেতে চাইছে; তামাটে অবয়ব রেখে যাচ্ছে পানিতে। আর আকাশে তারই ধোয়াটে উজ্জ্বলতা, যেনো আগুন লেগেছে প্যাপিরাসের ঝরে।
বেলাভূমির জনতা আরো বেপরোয়া, আরো অধৈৰ্য্য হয়ে উঠছে প্রতি ক্ষণে। একজন মাতাল নাবিক, আর শান্ত-সৌম্য পোশাকের মন্দির-পরিচর্যাকারিনীকে দেখলাম অগ্নিকুণ্ডের ওপাশের ছায়ায় হারিয়ে যেতে। নিজের আঁটো জামা খুলে মেলে ধরলো মেয়েটা; হাঁটু গেড়ে বসে বিশাল পেছনটা উপরে উঁচিয়ে রাখলো। যেনো কোনো কামার্ত কুকুরের মতোই উল্লাসের আনন্দে চিৎকার করে ওর উপর চড়ে বসে নাবিক; কিছুসময়ের মধ্যেই তার মতোই জোর শীৎকারে কেঁপে উঠে মেয়েটা। ওদের আলিঙ্গনবদ্ধ ছবিটা এঁকে নিতে লাগলাম আমি, কিন্তু আলো কমে আসছিল দ্রুত; তাই সেই দিনের মতো ক্ষান্ত দিতে হলো।
স্ক্রোলগুলো একপাশে রাখতে গিয়ে মনে পড়ল, বাচ্চা মেয়েটার মৃতদেহ। আবিষ্কারের পর থেকে আমার মিসট্রেসকে দেখছি না। আতঙ্কে চট করে দাঁড়িয়ে গেলাম। কেমন করে এতটা বেখেয়াল হতে পারলাম? আমার মিসট্রেস কঠোর অনুশাসনের মধ্যে বড় হয়েছে, আমি নিজে নিশ্চিত করেছি সেটা। সৎ আর শুভ্র মেয়ে ও; আইন এবং আচার তার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে, সে সম্পর্কে সচেতন। ওর বাবার রাগের সামনে আমি যতোটা অসহায়, লসট্রিস তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। অবশ্যই আমি ওকে বিশ্বাস করি।